গ্লিটজ: আপনার পুর্বপুরুষরা তো জমিদার ছিলেন…
এটিএম শামসুজ্জামান: আমার পুর্বপুরুষদের মধ্যে প্রথম পুরুষ মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ভোলাকোটের জমিদার ছিলেন। তিনি একটু মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন। তার ছেলের নাম অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। অনন্ত মুসলমানদের সংস্পর্শে আসতেন। তিনি একবার ঘুমের মধ্যে কোরআন শরিফ পেলেন; সেটা নিয়ে ফকিরের কাছে গেলে তাকে মুসলমান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। মুসলমান হয়ে অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম হয় আন্তি মুহাম্মদ। ছেলে ধর্মান্তরিত হওয়ার খবরে মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায় হাতির পিঠে চড়ে শপথ করলেন পুত্রকে গুলি করে না মারা অব্দি জলও স্পর্শ করবেন না। আমরা কিন্তু ব্যানার্জি পরিবারের ছিলাম। ওই বংশেরই দ্বাদশ পুরুষ সম্ভবত আমি।
গ্লিটজ: নিজেকে কী পরিচয়ে পরিচিত করাতে চান?
এটিএম শামসুজ্জামান: আমার প্রথম পরিচয়, বাঙালি। তারপরে মুসলমান। আমি যখন বাঙালি তখন বাঙালিয়ানাটাও ঠিকঠাকভাবে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু সেটা হয় না খুব একটা। আপনি খেয়াল করুন, ‘জলোচ্ছ্বাস’, ‘জলপ্রপাত’ বলি, কিন্তু জলকে ‘জল’ না বলে ‘পানি’ বলছি। কেন? বেশিরভাগ মুসলমান জলকে পানি বলে। অথচ সনাতনীরা জলকে জল বলে। আসানসোলটা অতিক্রম করলে একটা বাঙালিও পাবেন না। পানি উর্দু শব্দ। ভাষার মাসে বলছি, বাংলায় কথা বলা সহজ, কিন্তু বাঙালি হওয়া সহজ না। জলকে পানি বলতে শিখুন।
গ্লিটজ: ধর্মকে পুঁজি করে পুরান ঢাকায় রায়ট হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। সেই সময়ের কোন স্মৃতি আপনাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়?
গ্লিটজ: রায়টের ৭০ বছর পরও আমরা সেই সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরুতে পেরেছি?
এটিএম শামসুজ্জামান: সাদা কাপড়ে চায়ের দাগ পড়লে সেটা উঠে না। এটা (সাম্প্রদায়িকতা) হচ্ছে চায়ের মতো। সাদা কাপড়ের উপর দাগটা পড়েছে, সেটা কোনো কিছু দিয়েই উঠানো যাবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত কাপড়টা ফেলে দেওয়া হয়। আজকে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতার পেছনে সেই চায়ের দাগই দায়ী। কোনো আড্ডা থেকে একজন সনাতনী উঠে যাওয়ার পর আমরা বলি, ‘মালাউন তো উল্টাপাল্টা কথা বলে গেল।’
অথচ শরৎ বসু বলে গেছেন,‘ধর্ম মানে সংমিশ্রণ নয়, ধর্ম মানে মিলনমেলা।’ পহেলা বৈশাখে অবশ্যই সবাই যাবো। কালীপূজায় অবশ্যই যাবো; মুসলমানরা নমস্কার করব না। কিন্তু দেখতে তো অসুবিধা নেই।
আমার প্রশ্ন হলো, একটা ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে জামায়াত নির্বাচনে কীভাবে দাঁড়ায়? ৯৩ দিন আমি প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জামায়াতের বিরুদ্ধে। হাছান মাহমুদ আর শাজাহান খানকেও দেখেছি সেখানে। আমরা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শুধু এটাই বলব, সাম্প্রদায়িকতা দেশে এখনও বিলুপ্ত হয়নি।
গ্লিটজ: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘সীমার’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও করেছিলেন আপনি…
এটিএম শামসুজ্জামান: স্বাধীনতার পর ছবিটা করেছিলাম। জঙ্গিদের সেই সময় থেকেই কথা বলেছি আমি। তখন এই দেশে কোনো জঙ্গি ছিল না। কত অ্যাডভান্স চিন্তা ছিল আমার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ধরনের অনেক গল্প আমি লিখেছি। পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধুর নাম স্ক্রিনে এলে কালো কালি দিয়ে স্ক্যাচ করা হতো; তখন আমি সিনেমার গল্প লিখলাম, ‘চিৎকার।’ সেই গল্পে ৭ই মার্চের ভাষণ দেখালাম। সেন্সর বোর্ড দৃশ্যগুলো কাটতে পারেনি। হলে দর্শকরা ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হয়েছিল। নিজের কাছে ভালো লাগে যে, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি।
গ্লিটজ: ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইয়ে উল্লেখ আছে, যুদ্ধের সময় বেতারে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন আপনি। বিষয়টি নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
এটিএম শামসুজ্জামান: মিলিটারির গাড়ি যখন যেত ভিয়েতনামের মতো, মেয়ে কেঁদে উঠলে মুখ চেপে ধরতাম। সেইসব দুঃখের দিনে সেখান থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হত টিভি থেকে।… এরা অবরুদ্ধ অবস্থায় এগুলো করেছে। বিশেষ করে শিল্পীরা। মনে হয় না এই বিষয়ে আর কথা বলার দরকার আছে। কারণ সেই সময়ে আরও অনেকে এগুলো করেছে। অনেকে করেছে যাদের নাম বইয়ে নেই।
পরে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, যারা মানুষ হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, নির্যাতন করেছে তাদের ছাড়া বাকি সবাইকে ক্ষমা করে দাও। ১০ জানুয়ারি উনি ক্লিয়ার করে দিয়েছেন। অন্য যারা অপরাধ করেছেন, মানুষ হত্যা করেছেন পাকবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন তারা ছাড়া বাকিরা নির্দোষ। বাকিদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে নতুন করে কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
এরশাদের বিরুদ্ধে কিন্তু আমি সংগ্রাম করেছি। আমি, হাসান ইমাম টিএসসিতে সভা করেছি, মারও খেয়েছি। কাজেই শিল্পী বেচারাদের উপায় থাকে না। কারণ তাদেরকে ডেকে পাঠানো হয় এবং বলা হয়, এটা করতে হবে; এরা করবেটা কী? এই সত্যটা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছেন। করেই তিনি বলেছেন, এই নিয়ে আর কথা বলো না।
এটিএম শামসুজ্জামান: জোর করে মানে; আমি তো নানান জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছি ২৫ মার্চের পর। শেষে তাবলীগে গিয়ে ঢুকেছিলাম। পালিয়ে বেড়ালাম। শেষে টিভির লোক বাসায় এলো। বাবাকে বললেন, আপনার ছেলে কোথায়? বাবা বললেন, জানি না। তারা বললেন, তাকে যদি আপনারা না পাঠান তাহলে আপনাকে ধরে নেওয়া হবে। তথ্য এল আমার কাছে। আমি তখন বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে উকিল বাবার ওখানে থাকি। তখন শুধু বাবাকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হল। অনেকেরই এরকম ইতিহাস আছে।
গ্লিটজ: বেতারের ওই অনুষ্ঠানে আর কে কে ছিলেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: আমার সঙ্গে নাজমুল হুদা ছিলেন। যে কথাগুলো লেখা থাকত সেগুলো কোনোরকমে ছেড়ে দিতাম।..মেরে ফেলবে, ধরে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুন ভাই এতেকাফে বসার কথা বলে পালিয়ে এলেন। তখন বেতারেও যা, টেলিভিশনেও তা চলছিল। অসহায় অবস্থা ছিল।
শিল্পীরা সবসময় অসহায়। যখন যে সরকার আসে, তার পক্ষে তাকে কথা বলতেই হয়। এখন আওয়ামী লীগ সরকার আছে, ন্যাচারালি বিএনপি এসে যদি বলে, তুই ওর পক্ষে কাজ করলি কেন? তখন কী বলব? নিজের এক্সিসটেন্সের জন্য, বাঁচার জন্য করতে হয়েছে।
আমি তো অভিমান করে অনেকদিন টেলিভিশনে যাইনি। ক্যু’র সময় মন্টু মামা বললেন, আমাকেও তো মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি তো অভিমান করিনি। তুই অভিমান করেছিস কেন? বহুদিন পর গিয়েছিলাম। গেলেই আমার খারাপ লাগে। ওই জন্য ফিল্মে সহকারীর পরে অ্যাক্টিং করা শুরু করলাম। সংসার-বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য অভিনয় শুরু করলাম। এই বয়সেও আমাকে পরিশ্রম করে খেতে হচ্ছে।
গ্লিটজ: সেই ঘটনার জন্য আপনার মধ্যে এখন কোনো অনুশোচনাবোধ কাজ করে?
এটিএম শামসুজ্জামান: অনুশোচনা কেন কাজ করবে? আমি যদি ইচ্ছা করে এগুলো করতাম, কোনো মানুষ খুন করতাম, কারও বাড়িতে আগুন দিতাম, পাকিস্তানি সৈন্যকে সাহায্য করতাম, তাহলে সেটা ওকে। তা তো করিনি। ফলে অনুশোচনার তো প্রশ্নই আসে না।
সেই কলঙ্কজনক ঘটনার কথা এখন আর আলোচনা করতে চাই না।
গ্লিটজ: যুদ্ধোত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাধিকবার আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে। উনার কাছ থেকে কী ধরনের পরামর্শ পেয়েছিলেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: পাকিস্তান আমলে প্রত্যেক দলের একজন নেতাকে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন বিটিভিতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিটিভির মেকআপম্যান আব্দুস সালাম মেকআপ করছিলেন; পেছনে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। উনি আমাকে বললেন, ‘তোরা সিরাজদৌল্লার চরিত্র আনোয়ার হোসেনকে কেন দিলি, আমাকে দিতে। আমি ওর চেয়ে লম্বা, গলাও ভালো।’ (হা হা)
এরপর দেশের চরম খারাপ অবস্থায় ১৯৭২ সালের দিকে কিছু টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে বঙ্গভবনে শিল্পীরা গেলাম। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক নারী ছিলেন রহিমা খালা। উনি ডাক দিলেন, ‘এই মুজিব এদিকে আয়। তোর জন্য আমরা কিছু টাকা নিয়ে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘খালা তোমাকে ধন্যবাদ।’
শিল্পীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতাটা মনে রাখার মতো। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু যেন রহিমা খালার সন্তান। যেন মা-ছেলে কথা বলছেন। একবারও মনে হয়নি, তিনি রাষ্ট্রনায়ক, তিনি জাতির পিতা। এই ছিল শিল্পীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এই যে আন্তরিকতা। আনোয়ার হোসেনকে দেখলেই বলতেন, নবাব সাহেব! ঠিক একই রকম আন্তরিকতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এমন শিল্পীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী দেশে আর আসবেন না। দল-মত নির্বিশেষে তিনি সহায়তা করেছেন। উদাহরণ হলেন, আমজাদ হোসেন। লক্ষ লক্ষ টাকা দুই হাতে বিলিয়েছেন। কেউ খবর না দিলে নিজে শিল্পীদের খবর নিয়েছেন। এই প্রধানমন্ত্রী শিল্পীদের মা, আপা। আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে। বাংলাদেশের ভাগ্য, শিল্পীদের ভাগ্য। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে কোনো শিল্পী বিনাচিকিৎসায় মারা গেছে-এটা কেউ বলতে পারবে না। সেই দিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চেয়েও অধিক প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভেতর থেকে দোয়া আসে।
গ্লিটজ: প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আপনাকেও ২ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল…
এটিএম শামসুজ্জামান: ঘটনাটা বলি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সচিব আব্দুল মালেক একবার ফোন দিলেন; বললেন শিল্পীদের জন্য ১০ কাঠা করে জমি বরাদ্দ করেছেন। সই করে দিলে আমিও জমিটা পাবো। আমি বলেছি, জমির দরকার নেই। পরে উনি বললেন, ‘আপনার জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না? আমার স্ত্রী বললেন, ‘ওনার একটা শখ আছে, মনের মতো একটা ছবি করবেন।’
মালেক সাহেব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন। মালেক সাহেবকে বললাম ,প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আমাকে ২ কোটি টাকা দিতে হবে। তাহলে আমার মনের মতো করে একটা সিনেমা বানাতে পারব। যদি উনি দেন। তাহলে আমি নেব।
গ্লিটজ: টাকা পেয়েছেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: মাস দেড়েক আগে কথা হয়েছিল ওই বিষয়টা নিয়ে। এখনও পাইনি।
গ্লিটজ: আপনি যে সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বললেন, ওটার গল্প কী?
এটিএম শামসুজ্জামান: মাথায় আছে প্লটটা। মানুষ কখন সত্য কথা বলে? এর আগে মানুষ লুকোচুরি করে। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে লুকোচুরি করে। একটা পর্যায়ে এসে সত্য কথা বলে। এমন প্লটের গল্পটার নামই দিয়েছি, ‘এখন বলা যায়।’