গ্লিটজ: আপনার জন্ম নোয়াখালী; কিন্তু বেড়ে উঠা পুরানো ঢাকার দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে। আপনার বয়স যখন ১০-১১ বছর, তখন ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল ঢাকায়; সেই সময়ের কোনো স্মৃতি মনে আছে?
এটিএম শামসুজ্জামান: আমরা তখন আরমানিটোলা মাঠে খেলতাম। একদিন বেলা ৩টার দিকে নিজামুল হক মাঠে একটি টেবিলে হারমোনিয়াম নিয়ে কণ্ঠে ভাষার গান তুললেন, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি’। পুরো মাঠের একমাত্র শ্রোতা ছিলাম আমি। গানের কথাটা কে লিখেছিলেন সেটা জানি না কিন্তু সুরটা এখনও মনে গেঁথে আছে। পরে গাফফার চৌধুরী ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি লিখলেন।
গানে গানে প্রতিবাদের পাশাপাশি তখন ভাষা আন্দোলনকারীদের সহায়তার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আমাদের এলাকায়। ভাষা শহীদদের সহায়তার জন্য টিনের কৌটা বাচ্চাদের হাতে দেওয়া হলো। দোকান থেকে দোকানে টাকা তুলে দিয়েছিলাম আমরা; এটা মনে আছে।
ছোটবেলায় শুধু বুঝতাম, ভাষা শহীদদের গুলি করা হয়েছে, অন্যায় করা হয়েছে। সেই তাগিদ থেকেই যতটুকু পেরেছি কাজ করেছি। কিন্তু নিজেকে ভাষা আন্দোলনকারী হিসেবে কখনো দাবি করিনি। আমাকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছিল; পদকটা তো আমি প্রথমে নিতেই চাইনি।
গ্লিটজ: একুশে পদক নিতে অস্বীকৃতি কেন জানিয়েছিলেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: এটা তো তিক্ত কথা হয়ে যাবে। আমি তিক্ত কথায় অভ্যস্থ না। আপনি নিজেও জানেন, একুশে পদক কারা কারা পেয়েছেন। …যাই হোক, একবার হাসানুল হক ইনু ভাই আমাকে বললেন, ‘আমি দিচ্ছি, পদকটা আপনি নেন’। আমি বললাম, আপনি দেন আর যাই দেন আমি নেব না।
ভাষা আন্দোলনে তো আমার কোনো অবদান নাই। আমি কেন একুশে পদক নেবো? টুকটাক লেখালেখি করি, ফিল্মে অভিনয় করি- এই তো। ফিল্মে আমি কী অভিনয় করি? আমাকে তো সিনেমায় দেশের শ্রেষ্ঠ হনুমান বানিয়ে রাখা হয়েছে।
গ্লিটজ: সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তকে লেখালেখিতে গুরু মানতেন, দৈনিক সংবাদে নিয়মিত লেখাও বেরুতো। আপনার লেখালেখির জগতটা কেমন ছিল?
এটিএম শামসুজ্জামান: লেখা শেষ করেই আমি রণেশদা’কে দেখাতে যেতাম। রণেশদা আমার সঙ্গে অফিসে বসে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করতেন। বিরক্ত হয়ে সন্তোষদা বলতেন, ‘এই ছেলেকে নিয়ে বসে থাকেন কেন?’ রণেশদা বলতেন, ‘মুরগী ডিম পাইড়া কক কক করে কেন জানো? গৃহস্বামীকে জানায় সে ডিম পেরেছে। এই ছেলেটা ডিম পেড়ে এসেছে। তাকে খেদিয়ে দিলে ডিম পাড়া ছেড়ে দিবে।’
উনি সেই সময় আমাকে সাহায্য না করলে আমার লেখালেখির চর্চাই হতো না।
গ্লিটজ: আপনি নিজে লেখক হতে চাইতেন; কিন্তু আপনার বাবা নুরুজ্জামান নিজের মতো আপনাকেও উকিল বানাতে চেয়েছিলেন। অভিনয়ে এলেন কীভাবে?
এটিএম শামসুজ্জামান: অভিনয় শুরুর পর তো বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরই করে দিলেন। তখন পাশের গলির জাফরান ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। ওনার মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। পরে অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার আগে জাফরানের মা মারা গেছে। খুব কেঁদেছিলাম। অভিনয়ের পেছনে জাফরানের মায়ের ভূমিকা কখনোই ভুলতে পারব না। অনেক আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।
এরপর ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ করলাম ভিন্ন স্টাইলে। ছবিটি দেখে জজ সাহেব বাবাকে ডেকে পাঠালেন; বললেন, ‘এটিএম কী তোমার পোলা?’ বাবা বললেন, ‘ধরা পড়েছে নাকি?’ ‘আরে মিয়া তা না। গোলাপী এখন ট্রেনে দেখেছো?’ বাবা বললেন, ‘ধুর আমি ছবি দেখি নাকি? ‘তোমার পোলা খুব ভালো অভিনয় করেছেন।’
অভিনয়ের জন্য প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল বাচসাস পুরস্কার। বড় চাচা সিরাজুল হক সাহেব বাবার সামনে পুরস্কারটা দেখে বললেন, ‘এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। বাচসাস তোমার ছেলেকে পুরস্কার দিয়েছে। ইউর সান ইউ এ ফ্লাওয়ার’। বাবা শুধু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘জি ভাইয়া।’
গ্লিটজ: আপনি তো শৈশব থেকেই সিনেমার পোকা ছিলেন; প্রেক্ষাগৃহে প্রচুর ছবি দেখতেন…
এটিএম শামসুজ্জামান: মায়ের সঙ্গে প্রথম ছবি দেখেছিলাম ‘নিউ পিকচার হাউসে’। প্রথম ছবির নামটা ছিল ‘ঝুলা’, পরে দেখলাম ‘দাসী’। মায়ের সঙ্গে ছবি দেখতে দেখতে ছবির প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল আমার। সেই তাড়না থেকেই হয়তো আমার অভিনয়ে আসা।
গ্লিটজ: কখনও নায়ক হতে চেয়েছিলেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: মানুষ আয়না দেখে; আমি কম দেখেছি। যে দুই-চারবার দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, এই লোকটা জীবনেও নায়ক হতে পারবে না। ওই বাসনা আমি ত্যাগ করেছি। পরে মনে হয়েছে ‘হ্যাঞ্চব্যাক অব নটরডেমের’র মতো ছবি হলে হয়ত নায়ক হতে পারব।
গ্লিটজ: নায়ক হওয়ার জন্য চেহারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: ছবি চলে প্রথমত গল্পের জোরে। আর দ্বিতীয়ত হিরোকে অবশ্যই সুদর্শন হতে হবে। সুন্দর দেহের অধিকারী আর চেহারাটা মিষ্টি হতে হবে। চরিত্রাভিনেতাদের জন্য ছবি কিন্তু চলে না। তারা হচ্ছে তরকারিতে জিরার মতো।
গ্লিটজ: কৌতুকাশ্রিত খলঅভিনয়ের ধারণাটা কীভাবে পেলেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: সবার চেয়ে একটু আলাদাভাবে দেখার চেষ্টা করি। সেসময় মনে হলো অন্য স্টাইলে যাবো। কমেডি স্টাইলে গেলাম; সেটাই দর্শক গ্রহণ করল। ‘নয়নমনি’ রিলিজ পাওয়ার সুপারহিট হলো। ওই ছবি দিয়েই আমার পরিচিতি বেড়ে গেলে। পরে দিলীপ বিশ্বাসের ‘আসামী’ চলচ্চিত্র প্রচুর ব্যবসা করলো।
গ্লিটজ: অভিনয় জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?
এটিএম শামসুজ্জামান: চিড়িয়াখানায় গেলে সবার আগে কোন প্রাণী দেখতে যান আপনি?
গ্লিটজ: বাঁদর?
এটিএম শামসুজ্জামান: হ্যাঁ। আমি দেশের শ্রেষ্ঠ হনুমান। হনুমান বলে আমাকে চিহ্নিত করতে পারেন, নট অ্যাজ আন অ্যাক্টর। কারণ আমাকে কোনো চরিত্রই দেওয়া হয়নি। আমি মনে করি না আমার কোনো প্রাপ্তি আছে। আমার অনেক অপ্রাপ্তি আছে।
গ্লিটজ: তাহলে চারশও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কেন?
এটিএম শামসুজ্জামান: ভাত খাওয়ার জন্য অভিনয় করেছি; শুধু এক্সিসটেন্সের জন্য।
(চলবে…। শেষ পর্ব প্রকাশ হবে বুধবার)