গানের ভুবনে দুই মহারথী বাবা-মায়ের পারিবারিক খ্যাতিকে পাশ কাটিয়ে হয়ে উঠেছেন ব্যান্ডের তারকা।
Published : 25 Jul 2024, 09:51 PM
ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে শুনতে বড় হওয়া ছেলেটাই পরে হয়ে ওঠেছিলেন রকস্টার। গানে আর সুরে মাতিয়েছেন দর্শক-শ্রোতাদের। গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন, দেখেছেন জীবনের নানা বাঁক বদল। বৃহস্পতিবার সকালে ব্যান্ড সংগীতের সেই তারা হারিয়ে গেল, একেবারে থেমে গেল শাফিন আহমেদের কণ্ঠ।
আশি ও নব্বইয়ের দশকের কিশোর-তরুণ শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়ে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ ব্যান্ড তারকা দেশে ও দেশের বাইরে কনসার্টও মাতিয়েছেন গিটার হাতে। তার ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’, নীলা, আজ জন্মদিন তোমার, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘ধিকি ধিকি’ এর মত গান মুখে মুখে ফিরেছে সবার।
মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম ভোকালিস্ট শাফিন আহমেদ গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে কনসার্টে গানও করেন। আরও একটি কনসার্টে অংশ নেওয়া আগেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই বৃহস্পতিবার সকালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।
পরিবারের সদস্যরা বলেন, গত ৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন শাফিন। একটি কনসার্টে গানও করেন। ২০ জুলাই ভার্জিনিয়াতে আরেকটি কনসার্টে গান করার কথা ছিল। এর আগে অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে (বাংলাদেশ সময়) হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় এ ব্যান্ড তারকার।
গানের জগতে নিজের পরিচিতি নিজেই গড়ে তুলেছিলেন; পেয়েছেন রকস্টার খ্যাতি। গানের ভুবনে তার পরিবারের খ্যাতিকে পাশ কাটিয়ে হয়ে উঠেছেন ব্যান্ডের তারকা।
পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ছোটবেলা থেকেই গানের আবহে বেড়ে উঠেছেন শাফিন। বাবার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত আর মায়ের কাছে নজরুলগীতি শিখেছেন।
বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনের দুই মহারথী সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম এবং সুরকার কমল দাশগুপ্তের ছেলে শাফিন নিজে ছিলেন বেইজ গিটারিস্ট, সুরকার এবং গায়ক।
তার বাবা কমল দাশগুপ্ত উপমহাদেশের কিংবদন্তি সুরকার। কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ গানেরই সুর করেছেন তিনি। শাফিনের মা ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে নজরুল সংগীত অনেক বেশি সাধারণের কাছে পৌঁছায়।
ধ্রুপদি আর নজরুলের গানের সুর শুনে বেড়ে ওঠা শাফিন নজরুল সংগীতে না ঝুঁকে বেছে নেন ব্যান্ড সংগীতের পথ। ওয়েস্টার্ন ধাঁচের রক গান গাইতে শুরু করে নিজের একটি আলাদা ধাঁচ ও পরিচিতি তৈরি করেন; নিজেকে নিয়ে যান দেশের ব্যান্ড সংগীতের অনন্য উচ্চতায়।
বড় ভাই হামিন আহমেদসহ ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে পশ্চিমের সংগীতের সঙ্গে সখ্য হয় শাফিনের। শুরু হয় তার ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা।
একরকম শখের বশেই ১৯৭৯ সালে তারা গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল ‘মাইলস’। প্রথম কয়েক বছর তারা বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলে ইংরেজি গান গাইতেন। পরে মাইলসের বাংলা গানের প্রথম অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’ বের হয় ১৯৯১ সালে।
ওই অ্যালবামের জনপ্রিয়তার পর বিটিভিতে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে মাইলসকে। ধীরে ধীরে মাইলস দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ডদলে পরিণত হয়।
রক গানে ঝুঁকলেন কীভাবে?
কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের ছেলে শাফিন কীভাবে রক গানে ঝুঁকলেন? এই বয়ান উঠে এসেছে স্বয়ং শাফিন আহমেদের কণ্ঠে। ছাপাখানার ভূত থেকে প্রকাশিত শাফিন আহমেদের আত্মজীবনীভিত্তিক গ্রন্থ ‘পথিকার’ এ শাফিন বলেছেন তার জীবনের নানা বাঁক বদলের অজানা কাহিনী, যা লিপিবদ্ধ করেছেন সাজ্জাদ হুসাইন।
শাফিনের ভাষ্য, “আমরা তখন গুলশানের বাসায় থাকি। গুলশানের বাসায় থাকা অবস্থায় কিছু নতুন বন্ধু হল, যারা ওয়েস্টার্ন মিউজিক শোনে। তাদের কাছে বিদেশি রেকর্ড রয়েছে। তাদের কাছ থেকে কিছু রেকর্ড বাসায় নিয়ে আসতে শুরু করলাম। ইংরেজি গান, ওয়েস্টার্ন রক মিউজিকের গান যখন আসলো- তখন এর একটা প্রভাব পড়লো আমার উপর।
“বাসায় তো দেশীয় সংগীত চর্চা দেখে আসছি ছোটকাল থেকে, জন্মের পর থেকে। কিন্তু ওই ওয়েস্টার্ন রেকর্ড যখন আসতে শুরু করল (থার্টি থ্রি আরপিএম লঙ প্লে রেকর্ড) ওগুলোতে ব্যান্ডগুলোর ইমেজ-টিমেজ দেখে মাথা নষ্ট অবস্থা। তখন পিংক ফ্লয়েড, লেড জ্যাপলিন, বব ডিলান, বিটলস শুনছি, রোলিং শুনছি, স্যানটানা শুনছি অনেক। এদের অ্যালবাম হাতে পেলে মনে হতো সোনার টুকরো হাতে পেয়েছি। এত মূল্যবান মনে হতো।”
বাবার কাছেই গিটার টিউনিং
শাফিনের ধারণা ছিল, তার বাবা-মা উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ হলেও ওয়েস্টার্ন বাদ্যযন্ত্রের পারদর্শী নন। ওয়েস্টার্ন মিউজিক খুব একটা বুঝতে পারবেন না। কিন্তু সেই ভুল ভেঙেছিল একদিনের ঘটনায়।
তার ভাষ্য, “ওই সময় একটা গিটার কারও কাছ থেকে এনে বাজানোর খুব চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রপারলি টিউন করা জানি না। আব্বা পাশের ঘর থেকে এসে একটা থিওরি দিলেন, যেটা টিউনিং করার লেসন হয়ে গেল আজীবনের জন্য। আমার ধারণা ছিল, আব্বা-আম্মা দেশি মিউজিক বোঝেন, এটা বুঝবেন না। কিন্তু আব্বা এসে সিম্পলি বুঝিয়ে দিলেন টিউন কী করে করতে হয়। এত লজ্জা পেয়েছিলাম ওইদিন।”
শাহবাগের রেললাইন পেরিয়ে স্কুলে যেতেন শাফিন
‘মনোজিৎ দাশগুপ্ত’ কিংবা ‘মুনা’ নামগুলো অচেনা মনে হলেও শাফিন আহমেদকে ছোটবেলায় তাকে পরিবারের সদস্যরা ডাকতেন মুনা বলে। কলকাতায় প্রথম স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে তার নাম রাখা হয়েছিল ‘মনোজিৎ দাশগুপ্ত’।
১৯৬৭ সালে তাদের পরিবার ঢাকায় আসার পর ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন শাফিন। ঢাকার স্কুলে ভর্তির আগেই নতুন পাসপোর্ট করা হয়, যেখানে নাম রাখা হয় মোহাম্মদ শাফিন আহমেদ। ‘পথিকার’ গ্রন্থে শাফিনের বয়ানে ষাট ও সত্তুর দশকের ঢাকার একটি আমেজও ওঠে এসেছে।
শাফিনের ভাষ্য “আমরা তিন ভাই কলকাতায় ওই চিপাগলি দেখতে দেখতে- হঠাৎ ঢাকার এই পরিবেশে এসে দেখলাম চারপাশ প্রচণ্ড খোলামেলা। বাচ্চা হিসেবে আমাদের ফিলিংটাই বদলে গেল। আনন্দ-ফূর্তি, খোলা জায়গা। ঢাকা তখন কলকাতার থেকে কিন্তু এগিয়ে। পরিবেশের দিক থেকে। কোয়ালিটির দিক থেকে। লাইফস্টাইলের দিক থেকে।”
শাহবাগে রেললাইন পেরিয়ে স্কুলে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেন তিনি বলেন, “এখন যেখানে জাদুঘরটা আছে, শাহবাগে-ওখান দিয়ে একটা রেলপথ ছিল। ওটার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে শটকার্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রি বিল্ডিং পার হয়ে ঢুকে যেতাম স্কুলে।”
বাবার দোকান দেখে, শাফিনের উপলব্ধি ‘জীবন বিচিত্র’
উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত যে ঢাকায় দোকান দিয়েছিলেন, সেই তথ্য হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। ‘পথিকার’ নামে শাফিনের যে আত্মজীবনী গ্রন্থটি বেরিয়েছে, সেটি মূলত ওই দোকানের নামেই।
শাফিন বলেন, “আমাদের দোকানের নাম ছিল ‘পথিকার’। যখন আমরা ভূতের গলিতে থাকি, তখন ইনকাম বাড়ানোর জন্য বাবা-মা মিলে একটা দোকান দিলেন। মূলত বই-খাতা, কাগজ-কলমসহ স্টেশনারি জিনিসপত্র পাওয়া যেত। একদম হাতিরপুল মোড়ে, প্রমিন্যান্ট জায়গায় ছিল দোকানটা। এটা আব্বা চালাতেন। মহাকালের পথিকৃৎ শিল্পী বস্তুগত পৃথিবীতে সর্বশান্ত হয়ে একটা দোকান খুলে বসলেন, পথিকার। এই পথিকার কে? এই পথিকার হলেন কমল দাশগুপ্ত।”
শৈশব-কৈশোরে বাবার জীবনের বাঁকবদল নিজ চোখে দেখে শাফিনের মনে হয়েছিল, “জীবন বড়ই বিচিত্র। অদ্ভূত! কোথা থেকে কোথায়? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে মিউজিক করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়ে এসে হাতিরপুলে দোকান। ট্র্যাজিক! ইটস ভেরি ট্র্যাজিক।”
জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা গল্পের সুতো বুনে শাফিনও তার জীবনকে করে তুলেছেন বিচিত্র। শাফিনের জীবন কেটেছে কলকাতা, ঢাকা ও লন্ডনে। ব্যক্তি জীবনকে অনেকটাই আড়ালে রাখা আলোচনায় আসেন মাইলস থেকে বেরিয়ে এসে।
জনপ্রিয় ব্যান্ড দলটির সঙ্গে তিন দশকের পথচলার সমাপ্তি টেনে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বেরিয়ে আসেন আসেন শাফিন আহমেদ। তবে তার সংগীত যাত্রা চলতে থাকে। তার বিভিন্ন সলো অ্যালবামও জনপ্রিয় হয়। পরে তিনি গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড দল ‘ভয়েস অব মাইলস’।
তিনি আলোচনায় এসেছিলেন রাজনীতিতে জড়িয়েও। জাতীয় পার্টি থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন পরে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে। আইনি জটিলতায় সে বছর ঢাকা উত্তর সিটির উপনির্বাচনও আর হয়নি।
শাফিন নামের বর্ণিল জীবনের প্রদীপটি বৃহস্পতিবার নিভে গেল যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে।
আরও পড়ুন
ঝরে গেল ব্যান্ড সংগীতের আরেক তারা, চলে গেলেন শাফিন আহমেদ
মিউজিক এখন কেউ কিনে শোনে না: শাফিন আহমেদ
জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ব্যান্ডশিল্পী শাফিন
জাপার ভাইস চেয়ারম্যান পদে ফিরলেন শাফিন
আসছে শাফিনের নতুন গান 'রুবারু'
শাফিন আহমেদের ভাবনায় বাংলাদেশের ক্রিকেট
আবারও 'মাইলস' ছাড়লেন শাফিন আহমেদ
নানামুখী অভিযোগ হামিনদের, 'নোংরামো' চান না শাফিন