সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে যারা এগিয়ে নিয়েছেন, তাদের অবর্তমানে এই ধারা রক্ষা করবে কারা? পাঁচজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে উত্তর খুঁজেছে গ্লিটজ।
Published : 30 Jun 2024, 01:39 AM
‘আমি আসলে গায়ক না বেসিক্যালি, জেদের বশে এই লাইনে আসা’-ওই জেদের বশে সংগীত জীবনে এসে একসময় বাংলার ব্যান্ড সংগীতের ‘গুরু’ হয়ে ওঠেন আজম খান।
প্রথমবার মঞ্চে উঠে পরিবেশন করেছিলেন নিজেদের সম্বল চারটি মাত্র গান। এরপর ধীরে ধীরে আজম খান এবং তার গানের পরিচিতি বাড়ে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে 'সালেকা মালেকা' আর 'হাই কোর্টের মাজারে' গান দুটি দিয়েই নিজেদের প্রথম রেকর্ড বের করেন।
বন্ধু নীলু, মানসুরের গিটার আর সাদেকের ড্রামসের সঙ্গে গান বাজনায় সিরিয়াস হয়ে আজম খান তৈরি করেন ব্যান্ড 'উচ্চারণ'। সেই ব্যান্ডের হাত ধরেই ষাটের দশকে বাংলা রক মিউজিকের যাত্রা শুরু হয়।
ওই সময়ই ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফিরোজ সাঁইসহ কয়েকজন মিলে গঠন করেন ব্যান্ডদল 'স্পন্দন'। ফকির আলমগীর নিয়ে আসেন 'ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী'।
তবে সব ছাপিয়ে আজম খানের গায়ে 'পপগুরু' কিংবা 'পপসম্রাট' তকমা লেগে যায়। ‘বাংলাদেশ’ গানটি গেয়ে সারা দেশ কাঁপিয়ে দেওয়া সেই কণ্ঠ থেমে গেছে প্রায় ১৩ বছর। আজম খান মারা যাওয়ার পর 'উচ্চারণ' ব্যান্ডের কার্যক্রমও থমকে গেছে।
বাংলার রক সংগীতের আরেক আইকন আইয়ুব বাচ্চুও বেঁচে আছেন তার গানে। ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘প্রেম তুমি কী’, ‘রুপালি গিটার’, ‘পালাতে চাই’, ‘ভাঙা মন নিয়ে’- গানগুলোর জনপ্রিয়তা আজও কমেনি।
আইয়ুব বাচ্চু নেই পাঁচ বছর, তার দল এলআরবি যেন ছন্নছাড়া, সদস্যরা দলছুট। বাচ্চুকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যান্ড দলটির সব কার্যক্রম যেন থেমে গেছে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেক সংগ্রামের পর পরিচিতি আর প্রতিষ্ঠা পায় এক একটি ব্যান্ড দল, কিন্তু একজন শিল্পীর মৃত্যুতে সেই দল হারিয়ে যায়। সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে যারা এগিয়ে নিয়েছেন, তাদের অবর্তমানে এই ধারা রক্ষা করবে কারা? বদলে যাওয়া বাস্তবতায় দলগুলো টিকবে কী করে?
কেউ কেউ মনে করছেন, ব্যান্ড মিউজিকের সেই সোনালি যুগ পড়ে গেছে। দলগুলো নিজেদের চেষ্টায় তৈরি হবে কিংবা গানগুলো বেঁচে থাকবে-তেমন দিন আর নেই।
তবে ব্যান্ড শিল্পীরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, আর্কাইভ তৈরি, ব্যান্ড সদস্যদের মধ্যে ভালো বন্ধন, গানের কম্পোজার তৈরি এবং কপিরাইট নিয়মের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে তা নতুন দলগুলোর টিকে থাকার জন্য সহায়ক হতে পারে।
উত্তরাধিকারী কারা?
দীর্ঘদিনের ঠিকানা ‘মাইলস’ ছেড়ে নতুন ব্যান্ড গড়েছেন শাফিন আহমেদ, নাম ‘ভয়েস অব মাইলস’। পালাবদলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এই শিল্পী মনে করেন, দেশের ব্যান্ড সংগীতের ঝাণ্ডা কারা বইবে, সেটা বলে দেওয়া সম্ভব না।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “ব্যান্ড মিউজিক তো খুব বেশিদিন আগের ব্যাপার না বাংলাদেশে। আশির দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে এটি একটি গতি পেয়েছে। একটা ভালো সময় ধারণ করেছে ব্যান্ডগুলো। নব্বই দশকে চূড়ান্তভাবে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে গেছে ব্যান্ড মিউজিক। শুরুর দিকে ব্যান্ড সংগীত নিয়ে অনেক সমালোচনা হত। অনেকে জিনিসটা সহজভাবে নিতে পারেনি৷ যার কারণে এটাকে অপসংস্কৃতি বলত অনেকে৷ এখন কিন্তু ব্যান্ড মিউজিক বাংলাদেশের মূলধারার মিউজিক হয়ে গেছে, সেটা কয়েক দশক ধরে। সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকার অবশ্যই আসবে৷”
নতুন নতুন ব্যান্ডগুলো সেই জায়গা নিতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ফ্রন্টলাইনে শুরুর দিকে ব্যান্ডের প্রধান মাথা হিসেবে আমরা যারা ছিলাম, তাদের অনেকেই কিন্তু এখনো কাজ করছে। অনেকগুলো ব্যান্ড এখনো সচল। সুতরাং আমরা তো আছি, গান গেয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। তারপর আমাদের পরবর্তীতে অনেকগুলো ব্যান্ড তাদের মত জায়গা করে নিয়েছে এবং আমরা না থাকলেও তারা কিন্তু ভালোভাবেই শ্রোতাদের আনন্দ দিতে পারবে৷ সেই লক্ষণটা অলরেডি দেখা যাচ্ছে। অনেক নতুন নতুন ব্যান্ড তৈরি হচ্ছে। তাদের অনেক ফ্যানবেজ তৈরি হচ্ছে।”
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গানগুলো সংরক্ষণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন শাফিন।
“আমাদের গানের পুরো ক্যাটালগ, গানগুলো ইন্টারনেটে তুলে রাখা; একবার তুলে রাখতে পারলে এটা স্থায়ীভাবেই থেকে যাবে। সেটা নিজের ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম হোক, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হোক, গানের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে রাখা দরকার।”
‘মাইলস, কিংবা ‘ভয়েস অব মাইলস’ অথবা এককভাবে শাফিন আহমেদের গানগুলোর হাল ধরার জন্য কাউকে তৈরি করার চিন্তা কখনো করেছেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে শাফিন বলেন, “কাউকে গান শেখানো, তৈরি করা… সেই সময় হয়নি। অন্যদেরকে তৈরি করে রেখে যাওয়ার সময় পাওয়াটা খুব কঠিন৷ নিজেরা যতদিন ব্যস্ত, নিজের কাজেই ব্যস্ত৷ তখন আর তৈরি করার কাজটা করার সময় হয় না। আমি এখনো যেভাবে রেকর্ডিং এবং লাইভ পারফরম্যান্স করছি, করতে হয়, এটা অনেকটা সময় নিয়ে নেয়৷ এরপরে আর কাউকে হাতে করে গড়ে তুলে দিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।”
দরকার প্রাতিষ্ঠানিক আর্কাইভ
‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সংগীত পরিচালক ফোয়াদ নাসের বাবুর কথায়, একজন শিল্পী তার গানের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন৷ ব্যান্ডের ক্ষেত্রেও তাই হবে।
“এখন কেউ যদি ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম নাও করে, সেই গানগুলো কিন্তু রয়ে যায়। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যেসব ব্যান্ড গান করেছে, এই প্রজন্ম সেসব তো গাইছে৷ গানের ধারায় হয়ত পারফর্মার জীবিত নেই বা পেশার সঙ্গে নেই, কিন্তু গানগুলো সৃষ্টি করে রেখে গেছেন ৷ দীর্ঘ সময় ধরে সেই গানগুলো অন্যরা গাইছেন, নতুন মাত্রা সংযোজন করেও কিন্তু গানগুলো বেঁচে আছে।”
অনেকের আসা-থাকলেও কেউ না কেউ হাল ধরেছেন ‘সোলসের’। ফলে এখনো চলছে তাদের কার্যক্রম।
আজম খানের ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বাবু বলেন, “আজম খানের জনপ্রিয় গানগুলো এই প্রজন্ম কেন, পরের প্রজন্মও গাইবে বলে আমার ধারণা। এটা সত্যি যে, তিনি চলে যাওয়ার পর তার গানের দল সেই ধারাকে বহন করতে পারেনি৷ দলের যে মূল গায়ক সে হারিয়ে গেলে দলটা কেউ ধরে রাখে না। তাছাড়া শ্রোতা দর্শকরা সেই মূল গায়ককে দেখেই কিন্তু ব্যান্ডের পরিচিতি তৈরি করে। গান, প্রধান গায়কের নাম ধরেই বলে এটা অমুকের দল, অমুকের ব্যান্ড, এটা তাদের গান৷ সেই জায়গা থেকে সেই মানুষের অনুপস্থিতিতে একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি করে।"
সংকটের কথা তুলে ধরে ফোয়াদ নাসের বাবু বলেন, “সত্যিকার অর্থে অডিও ইন্ডাস্ট্রি আমরা যখন শুরু করি তখন যে রকম রমরমা ছিল এখন কিন্তু সেটা নেই। সিডি বা ক্যাসেটের কোনো বাজার নেই। কেউ অ্যালবাম করে রেখে গেলেও সেটা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। কারণ সেই মাধ্যমটাই নেই।
“এখন মানুষের ভরসা অনলাইন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন স্ট্রিমিং, ইউটিউব, স্পটিফাই। বিজনেস স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোতে গানগুলো চলে। এখন গান চোখে দেখা যায়, হাতে ধরা যায় না। আগে ধরা যেত, ক্যাসেট, সিডি নিয়ে আলোচনা হত। এখন সব কিছু সহজলভ্য। এত বেশি গান মানুষ শুনতে পায়। মানুষের জীবনের ধারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ৩০ বা ৪০ বছর আগে মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করত সেটা আর নেই। ইউটিউবে যে গান রিলিজ হয় সেটা এখন কেউ পুরোটাও শোনে না।”
‘ফিডব্যাক’ ধরে রাখার দায়িত্ব কাকে দেবেন? এই প্রশ্নে বাবু বলেন, “আমাদের দরকার ছিল একটা বড় আকারের আর্কাইভ তৈরি করে রাখা। আমি যতটুকু জানি, ব্যক্তিগতভাবে ব্যান্ডগুলো তাদের গানগুলো সংরক্ষণে রাখে। তাদের যে অ্যালবাম বা ক্যাসেট বের হয়েছে, তা নিজেদের মত করে সংরক্ষণে রাখে। তবে এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের করা উচিত ছিল। যেন আজ থেকে ৩০ বছর ৪০ বছর পরে বলতে পারি গানগুলো আমরা রক্ষণাবেক্ষণে রেখেছি।”
প্রযুক্তি যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে গান শোনার মাধ্যম আরো অনেক বদলে যেতে পারে। তখনও যেন মানুষ ব্যান্ডের পুরনো গানগুলো শুনতে পারে, সেজন্য সংরক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছেন বাবু।
তিনি কলেন, “এটা আমাদেরই অক্ষমতা, আমরা এরকম আর্কাইভ গড়ে তুলতে পারিনি। এসব নিয়ে হয়ত কেউ ভেবেছে, কিন্তু কাজ করছে না। উত্তরাধিকার নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবা উচিত। এটা তো আমাদের সম্পদ, এটা আমাদেরই ধরে রাখতে হবে।”
ভাবা শুরু হয়েছে: বাবনা করিম
ব্যান্ডসংগীতের ধারাবাহিকতা রক্ষার দায়িত্ব কারা নেবে, সেই প্রশ্ন ওয়ারফেজের কণ্ঠশিল্পী বাবনা করিমকেও ভাবাচ্ছে। তবে তিনি আশাবাদী।
গ্লিটজকে তিনি বলেন, “এটা খুবই ভালো একটা পয়েন্ট। উত্তরাধিকার নিয়ে কয়েকটা গ্রুপ অলরেডি ভাবছে। আমার ধারণা, এটা প্রাকৃতিকভাবেই হবে। আমার হয়ত এটা নিয়ে ভাবার সময়টা কম, যেহেতু আমি প্রফেশনালি মিউজিক করি না, মিউজিক করি প্যাশন থেকে। তবে উত্তরাধিকার নিয়ে ভাবা শুরু হয়েছে। সুন্দর গান যেগুলো, যেমন লাকী আখান্দ, নিলয় দাশ, এদের অনেক সুন্দর সুন্দর গান রিমেক হয়েছে। সেভাবেই বেঁচে যায় গানগুলো।”
দল ধরে রাখতে যে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়, সে কথা তুলে ধরে বাবনা বলেন, “কিছু আর্টিস্ট আছেন, যেমন আইয়ুব বাচ্চু… তিনি এলআরবির সবচেয়ে বড় অংশ। উনিই সবকিছু ছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পরে উনার অনুপস্থিতিতে ব্যান্ডটা ধরে রাখা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। আর এটাই স্বাভাবিক। তবে একটা অর্গানাইজড ব্যান্ড সেটা ধরে রাখলে চ্যালেঞ্জের বাইরে গিয়ে ধরে রাখা যায়।
“উদাহরণ যদি দিই, ওয়ারফেজে অনেকেই এসেছে, গেছে। কিন্তু টিপুর (ড্রামার) কারণে, টিপুর দায়িত্বশীলতায় ব্যান্ডটি এখনো একসঙ্গে। এটা বলার কারণ হল, একটা ভালো জিনিস যখন ভালোভাবে চলতে থাকে, কোনো দুর্ঘটনার কারণে ওইটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটা অতিক্রম করে টিকিয়ে রাখা যায়। ব্যান্ডের যারা প্রধান, তারা যদি পার্সোনাল ইগো বা ছোট মানসিকতা বাদ দিয়ে ভালো কিছু অর্জন করতে পারে, ভালো কিছু করে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে।”
ব্যান্ডগুলোর মধ্যে ভালো বন্ধনও টিকে থাকার সংগ্রামে জরুরি বলে মনে করেন বাবনা করিম।
“আমাদের যারা ভালো গান করেন, ভালো ব্যান্ড, এরা সকলেই আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেট। এই অ্যাসেটগুলোকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। ব্যান্ডগুলোর সদস্যদের এক করা এটা একটা বড় ব্যাপার হতে পারে। তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে ছোট ছোট প্রতিযোগিতা না করে, রোষানল তৈরি না করে যেন একটা সুসম্পর্ক ধরে রাখে। তাছাড়া যারা ভালো গান গাচ্ছে তাদেরকে সাপোর্ট দেওয়া দরকার। মানুষ মারা গেলেই কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে, এটা কেন হবে? কপিরাইট আইনটা মানতে হবে, কারণ এই আন্তর্জাতিক যুগে সবার সঙ্গে সবাই কাজ করবে। কপিরাইটটা নিজের অধিকার।”
যারা টিকে আছে, নিজেদের চেষ্টায়: সাইদ হাসান টিপু
‘মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়’, ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’, ‘ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী’, ‘কলিকালের ভণ্ড বাবা’ কিংবা ‘বিধি তোমার কেমন খেলা’- ‘অবসকিউরের’ এই গানগুলোর কদর এখন ওয়েছে নব্বইয়ের দশকের শ্রোতার কাছে। ৩৭ বছর ধরে অবসিকউরের হাল ধরে আছেন সাইদ হাসান টিপু।
দলনেতার মৃত্যুতে ব্যান্ড টিকবে না, এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন তিনি।
গ্লিটজকে টিপু বলেন, “ব্যান্ডগুলোকে টিকিয়ে রাখার কিছু নেই। বাচ্চু ভাই ছাড়া এলআরবি হবে না, এটা খুব সোজা হিসাব। বাচ্চু ভাইয়ের স্ত্রী বলেছিলেন, এলআরবি দরকার নেই, যতটুকু করেছে ততটুকুই থাক। কেউ যদি মারা যায় সেই ব্যান্ড নিয়ে আর এগোনো যায় না। আর টিকিয়ে রাখতে চাইলে ইউটিউবে গান আছে, সেটা সবাই শুনতে পারে। 'উচ্চারণ' ব্যান্ডও চেষ্টা করেছিল কিছু দূর এগোতে, কিন্তু সেটা যে কোয়ালিটির হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়নি। কেউ যদি মারা যায়, সেটাকে চালিয়ে নেওয়া খুব কঠিন।“
অনেক ব্যান্ডের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আর্থিক বিষয়টিও যে জড়িত, সে কথাও বলেন টিপু।
“সবচেয়ে বড় কথা, ব্যান্ডের গানের খুব খারাপ অবস্থা আমাদের দেশে। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খারাপ। যারা টিকে আছে এরা নিজেদের চেষ্টায় টিকে আছে। আর কোনো উপায় নেই, কী করবে? আগে তো প্রোডাকশন কোম্পানি ছিল, সেটার জন্য কিছু টাকা হলেও পাওয়া যেত ৷ এখন তো স্টেজ শো ছাড়া আর কোনো গতি নেই। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গান রিলিজ পেলে যে টাকা আসে, তা খুবই সামান্য। সেটার সিংহভাগ প্রোডাকশন কোম্পানিগুলোই নিয়ে নিচ্ছে।”
‘অবসকিউর’ নিয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তা কী? টিপু বললেন, “অবসকিউর তো টিকে আছে। ৩৭ বছর ধরে আমি একা হাল ধরে আছি, যেভাবেই হোক আছি, গান রিলিজ করছি। যেখানে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিরই অবস্থা খারাপ, সেখানে ব্যান্ড সংগীতের কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। আমরা আছি সেটাই বড় কথা। অবস্থাটা এখন পকেটের পয়সা দিয়ে গান করার মত হয়ে গেছে। যারা পারছে করছে, নিজের খরচে, নিজের পকেট থেকে।”
গুরুত্বপূর্ণ টিম ওয়ার্ক ও কম্পোজার: নকীব খান
গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী নকীব খানের মতে, একটি ব্যান্ড সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করলে যুগের পর যুগ বেঁচে থাকে, টিকে যায়। আর একটি ব্যান্ডে কম্পোজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রেনেসাঁ ব্যান্ডের এই শিল্পী বলেন, “একটা ব্যান্ড যখন একজন মানুষকে নিয়ে সর্বস্ব হয়ে যায়, একজনই স্টার থাকে, প্রধান থাকে, যাকে ছাড়া সেটা অচল হয়ে যাবে, তখনই সেটা হারিয়ে যায়। ব্যান্ড সংগীত একটা টিম ওয়ার্ক, এটা সংঘবদ্ধ টিম, যেটার মধ্যে প্রত্যেকেরই কনট্রিবিউশন লাগে।
“যখন একজন কেন্দ্রিক হয়ে যায়, তখন ব্যান্ড আর থাকে না। ব্যান্ডের মূল গায়ক বা গিটারিস্ট যার নামে ব্যান্ড পরিচিতি পায়, তাকে ছাড়া দর্শক ওভাবে আর পছন্দ করতে চায় না। তবে এটি ব্যান্ডেরই দায়িত্ব টিম ওয়ার্ক তৈরি করা৷ কম্পোজার থাকলে ব্যান্ড কিন্তু টিকে যায়।”
উদাহরণ দিতে গিয়ে সোলসের প্রসঙ্গ টানেন নকিব, যিনি নিজেও একসময় ওই দলে ছিলেন।
“১৯৮৩ সালে আমি সোলস ছেড়ে দিই। তারপরে সোলস ধরে আইয়ুব বাচ্চু। আমি ছেড়ে আসার পর সেটা বাচ্চু ধরেছে। বাচ্চু কম্পোজ করতে পারত, নতুন গান তৈরি করতে পারত৷ তারপর বাচ্চু চলে আসার পর পার্থ বড়ুয়া হাল ধরে। একইভাবে সে নিজেই গান কম্পোজ করে, গান গায়৷ সেই জায়গা থেকে সবার সমন্বয়েই কিন্তু ওরা টিকে আছে। ওয়ান ম্যান শো যেন না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে।”
আগের প্রজন্মের অনেকের সন্তানরাও আসছেন ব্যান্ড জগতে। কেউ গাইছেন, কেউ বাজাচ্ছেন। কেউ দুটিই করছেন।
ব্যান্ড তারকা মাকসুদুল হকের ছেলে ডিও হক 'নেমেসিস' ব্যান্ডের ড্রামার। মাইলসের কি-বোর্ডিস্ট ও সুরকার-সংগীত পরিচালক মানাম আহমেদের ছেলে জেরিফ আহমেদ 'নেমেসিস' ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট। প্রয়াত পপ তারকা ফিরোজ সাঁইয়ের ছেলে নাজিম 'এক্লিপস' ব্যান্ডের ড্রামার। ফিরোজ সাঁইয়ের আরেক ছেলে নাঈম 'নাগরিক' ব্যান্ডের ড্রামার। মঈনুল ইসলাম খান ও কনকচাঁপা দম্পতির ছেলে মাশুক ইসলাম খান গড়ে তুলেছেন 'ডিএইচ' নামের ব্যান্ড।
নতুন প্রজন্মের হাত ধরে জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোও টিকে থাকবে, সেই আশাই করছেন সেনালী যুগ ফেলে আসা শিল্পীরা।