২০০৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। পরে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে আর গানেও ফিরেছিলেন।
Published : 05 Sep 2024, 10:08 PM
পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে দশ হাজারের বেশি গান কণ্ঠে তুলেছেন; তার কণ্ঠ জায়গা করে আছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। বাংলাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন পূর্ণ করলে জীবনের ৭০ বছর।
সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর; ঢাকায়। বুধবার এই শিল্পীর জন্মদিন কাটল আড়ম্বর ছাড়াই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “এখন বেশ সুস্থ আছি। এতেই খুশি।”
মূলত সাবিনা ইয়াসমিনের অনাগ্রহের কারণেই এবার জন্মদিনে স্বজনেরা ঘটা করে কোনো আয়োজন করেননি।
২০০৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। পরে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে আর গানেও ফিরেছিলেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফের সাবিনার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার খবর রটে। দেশের পাশাপাশি ভারতীয় গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয় এই খবর।
পরে সাবিনা ইয়াসমিন দেশবাসীর উদ্দেশে এক বার্তায় সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানান। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “প্রতিবছরই তাকে নিয়মিত চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এবার চেকআপে এসে দাঁতে সমস্যা দেখা দেয়। পরে গত ৭ ফেব্রুয়ারি দাঁতে ছোট একটি সার্জারিও হয়।”
অযথা বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমে দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্তিতে না ফেলতে অনুরোধ করেছিলেন এই সংগীতশিল্পী।
গত ৩১ মে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেন। তবে তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই চলতে হচ্ছে।
সাবিনা ইয়াসমিনের পৈতৃক নিবাস সাতক্ষীরায়। বাবার চাকরি সূত্রে নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি শহরে তার শৈশব কেটেছে। বেড়ে উঠেছেন সংস্কৃতিমনা পরিবারে। বাবা লুতফর রহমান ও মা মৌলুদা খাতুনও গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সাবিনার পাঁচ বোনের মধ্যে ফরিদা ইয়াসমিন, ফওজিয়া খান, নীলুফার ইয়াসমিনও গানের জগতের মানুষ।
কয়েক বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবিনা ইয়াসমিন বলেছিলেন, “ছোট থেকেই গান গাইছি। বাড়িতে একটা সংগীতের পরিবেশ দেখেছি। মা গান গাইছেন, বাবাও খুব ভালো গাইতেন। বোনেরা তো গাইছেন। আম্মার গানের গলা অসম্ভব সুন্দর ছিলো এবং তিনি গাইতেনও খুব সুন্দর। এত সুন্দর হারমোনিয়াম বাজাতেন, আমি অবাক হয়ে দেখতাম এবং শুনতাম।
আমার বড় বোন ফরিদা ইয়াসমীন, ফৌজিয়া খান উচ্চাঙ্গ শিখতেন ওস্তাদ দূর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে। আমরা তখন বাবার চাকরির সুবাদে নারায়ণগঞ্জ থাকতাম। আমি আর নীলুফার মাঝেমাঝে বসতাম তাদের পাশে। দেখতাম কী শিখছেন।”
তার শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি জানিয়ে সাবিনা বলেন, “গানের ব্যাপারটা আমার ভেতরে ছিলই। আমার মা ও নানা একসঙ্গে গান শিখতেন মুর্শিদাবাদে, ওস্তাদ কাদের বক্সের কাছে। তিনি সে সময়ের নামকরা একজন সংগীতজ্ঞ ও ওস্তাদ ছিলেন। সেই সময় মুসলিম নারীদের জন্য গান-বাজনা চর্চা করা সহজ ছিলো না। পরে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সংসারে ঢুকে গান-বাজনা কিছুই হলো না আম্মার।
“আমার মায়ের মনে জেদ ছিল এজন্য, আমাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের গান শেখানোর বিষয়ে। আরেকটা ব্যাপার, আম্মা পড়াশোনাতেও অসম্ভব ভালো ছিলেন, সেটাও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এজন্য আমাদের এ দুটি দিকেই সমান মনোযোগী করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।”
গীতিকার নয়ীম গহরের লেখা ও সুরকার আজাদ রহমানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া দেশাত্মবোধক গান ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
নজরুল ইসলাম বাবুর কথায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে সাবিনার কণ্ঠে অমর হয়েছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’গানটি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে সব শ্রেণির শ্রোতাদের মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন।
মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথমবার স্টেজে গান করেছেন সাবিনা; ১৯৬২ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম গান করেন। ১৯৬৭ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সিনেমায়।
এরপর আর ডি বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্য সাহা, সুবল দাস, আলম খান, বাপ্পি লাহিড়ী, আলী হোসেন, খন্দকার নুরুল আলম, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মত সুরকারদের সুরে অসংখ্য চলচ্চিত্রের গান কণ্ঠে তুলেছেন তিনি।
সহশিল্পী হিসেবে কুমার শানু, আশা ভোঁসলে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মত শিল্পীকে পেয়েছেন তিনি।
শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন।
সংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ও ১৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।