ভারতীয় সিনেমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন সিনেমার সঙ্গে বিশ বা ত্রিশ বছর আগের সাড়া ফেলা সিনেমাগুলো ফের হলে মুক্তির ব্যবস্থা করলে সেটি অর্থনীতিতেও অবদান রাখে।
Published : 28 Aug 2024, 04:04 PM
দিল্লির বাসিন্দা ২৬ বছর বয়সী জাকিয়া রাফিকি যখন শুনলেন যে হিন্দি সিনেমা ‘লায়লা মজনু’ নতুন করে প্রেক্ষাগৃহে আসছে, তখন তার প্রথমেই মনে পড়ল, ছয় বছর আগে তিনি যখন সিনেমাটি প্রথম দেখেছিলেন, তখনই জানতেন এ চলচ্চিত্র তার একবার দেখলে চলবে না।
জাকিয়া বলেন, “আমি প্রথবার যখন সিনেমাটি দেখতে যাই, প্রেক্ষাগৃহে তখন হাতেগোণা কয়েকজন। তারা সিনেমা দেখতে দেখতে হাসছিলেন, কখনো কাঁদছিলেন।”
বিবিসির প্রতিবেদকের সঙ্গে কথায় কথায় জাকিয়া বলেছেন, এবার তিনি তার বোনের সঙ্গে গিয়ে সিনেমাটি দেখেছেন। তার ভাষায়, সিনেমা মানুষকে নস্টালজিক করে তোলে।
“ভারত শাসিত কাশ্মীর অঞ্চলের দুটি মানুষের প্রেমের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল সিনেমাটির চিত্রনাট্য, যে প্রেম কেবল বেদনা ডেকে আনে। ওই সিনেমার চিত্রনাট্যের সঙ্গে আমার আবেগ মিশে গিয়েছিল, কারণ আমিও কাশ্মীরের মানুষ।
“বড় পর্দায় সেখানকার বাড়িঘরে ছোট ছোট দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছিল। যখন কাশ্মীরের রাস্তায় গাড়ি চলাচলের দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল, আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন সেখানেই রয়েছি।”
ইমতিয়াজ আলীর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় কোভিড মহমারীর দুই বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘লায়লা মজনু’ ফ্লপ হলেও এবারে নতুন করে চলতি মাসে মুক্তির পর দর্শকরা সিনেমাটি দেখছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ভারতীয় সিনেমা বিশ্লেষকরাও মনে করেন, নতুন সিনেমার সঙ্গে বিশ বা ত্রিশ বছর আগের সাড়া ফেলা সিনেমাগুলো হলে ফের মুক্তির ব্যবস্থা করলে সেটি অর্থনীতিতে অবদান রাখে। কারণ বিশ-পঁচিশ বছর আগে তরুণ-যুবকরা এখন মাঝ বয়সে এসে তাদের সময়কার সিনেমা দেখতে হলে ছোটেন। এর কারণ হল ‘স্মৃতির তারণা’।
সিনে বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘লায়লা মজনু’ সিনেমার চিত্রনাট্যই এমন যে দেখার জন্য যুগে যুগে মানুষের ভিড় দেখা যাবে।
কোভিড মহামারী ঘিরে সারা বিশ্বের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মত হিন্দি সিনেমার দুনিয়াতেও ধস নামে। গত কয়েক বছরে নানা ধরনের উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি। মহামারীর সময় থেকে স্ট্রিমিং সেবায় ঝুঁকেছে মানুষ, যে প্রবণতা এখনো চলমান।
সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জেনেছে, সিনেমা তারা আগের মতই ভালোবাসেন, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে তেমন একটা যাওয়া হয় না। বরং তাদের অপেক্ষা থাকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কখন তাদের কাঙ্ক্ষিত সিনেমাটি আসবে।
সিনেমা বাণিজ্য বিশ্লেষক কোমল নাহতা বলেছেন, নতুন সিনেমা মুক্তির জন্য চলতি বছরটি বলিউডে তেমন ভালো যাচ্ছে না।
তবে বলিউড ও দক্ষিণী তারকাদের নিয়ে নির্মিত দুটি সিনেমা ব্যতিক্রম। ‘কল্কি ২৮৯৮’ এবং ‘স্ত্রী ২’; সিনেমা দুটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর আয়ের হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি পাওয়া হরর কমেডি সিনেমা ‘স্ত্রী ২’ ভারতের প্রেক্ষাগৃহ থেকেই এখন পর্যন্ত চার বিলিয়ন রুপি আয় করে রেকর্ড গড়েছে।
আর সায়েন্স ফিকশন ঘরানার সিনেমা ‘কল্কি ২৮৯৮’ আয় রোজগার এবং জনপ্রিয়তায় এমন একটি উজ্জ্বল জায়গা নিয়েছে, যা নির্মাতা-প্রযোজকদের বলিউড নিয়ে আশাবাদী করে তুলেছে।
ভারতীয় দর্শকরা যেমন তাদের সিনেমা দেখার মাধ্যম নিয়ে নিজেদের অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন, তেমনি এই ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষিণী সিনেমার দাপট বাড়ছে। চলতি বছরে ভারতে শীর্ষ ১০টি সিনেমার মধ্যে তিনটি দক্ষিণের, যেগুলো সফল হয়েছে। এবং এই সিনেমাগুলোর বাজেটও বিশাল কিছু নয়।
বলিউডে কয়েক বছর ধরে নব্বইয়ের দারুণ দর্শকপ্রিয় কিছু সিনেমা নতুন করে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এই তালিকায় আছে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’. অ্যাকশন থ্রিলার সিনেমা ‘ম্যায় খিলাড়ি তু আনারি’, ‘বাজিগর’ এছাড়া ‘মিউজিক্যাল রকস্টার’, ‘বন্ধু ফিল্ম জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ এবং ‘যব উই মেট’ এর মত সিনেমার দ্বিতীয়বার মুক্তি দর্শকদের দারুণভাবে হলমুখী করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বড় চমক ছিল ‘লায়লা মজনু’ সিনেমা সাফল্য। চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলেছেন, তারা বিশেষভাবে খুশি যে কাশ্মীরের দর্শকদের এই সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কারণ সিনেমাটি যখন প্রথম মুক্তি পেয়েছিল, কাশ্মিরে তখন সিনেমা হল ছিল বন্ধ। প্রায় তিন দশক পর ২০২২ সালে কাশ্মীরে ফের প্রেক্ষাগৃহ চালু হয়।
বিশ্লেষক কোমল নাহতা বলেন, “‘লায়লা মজনু’ কেবল খরচ তুলে এনেছে তা নয়। পুরনো সিনেমা নুতন করে মুক্তি দেওয়া হলে বা সিনেমা রিমেক করলে সেটি ব্যবসা সফল হয় কী না সেটিও প্রমাণ করেছে।“
সিনেমা বিশ্লেষক তরণ আদর্শ বলেন, পুরনো সিনেমা নতুন করে মুক্তির এই চল নতুন ভালো সিনেমার অভাবও পূরণ করছে।
“পুরনো সিনেমা নতুন করে দেখানোর ক্ষেত্রে তেমন প্রচার খরচ নেই। টিকেট বুকিং সাইটে সিনেমার পোস্টারগুলো ছাড়তে হবে বা সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করতে হয়। দর্শকরা নস্টালজিয়া থেকে এই সিনেমাগুলো দেখতে আসেন।”
ভারতের দক্ষিণের সিনেমার দুনিয়াতেও তামিল এবং তেলেগু ভাষার পুরনো সিনেমা মুক্তি দেওয়ার প্রচলন আছে। যেমন ‘গব্বর সিং মুক্তি পেতে যাচ্ছে আগামী সপ্তাহে।
আরেকটি ভিন্ন ফর্মুলার কথাও জানালেন দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষক শ্রীধর পিল্লাই।
তিনি বলেন, "ধরুন এখনকার কোনো সুপারস্টারের পুরনো কোনো সিনেমা নুতন করে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, যিনি ২০ বছর আগে ক্যারিয়ার মাত্র শুরু করেছেন, তখন হয়ত সেটি তেমন নাম করেনি। কিন্তু ওই নায়ক বা নায়িকা এখন যেহেতু তারকা, তাই তার পুরনো সিনেমাও দর্শকরা এখন দেখতে আসবে। ”
মালায়ালাম সুপারস্টার মোহনলালের এরকম দুটি হরর সিনেমা আছে, দ্বিতীয় মুক্তি যেগুলোর নতুন জীবন দিয়েছে। এর মধ্যে ‘মণিচিত্রথাঝু’ ১৯৯৩ সালে এবং ‘দেবদূতন’ ২০০০ সালে মুক্তি পায়।
এর মধ্যে‘দেবদূতন’ প্রথমবার মুক্তির সময় দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়। এক মাসের বেশি সময় ধরে সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে চালানো হলেও তেমন কোনো লাভ হয়নি। পরের বার মুক্তির পর এই সিনেমা ভালো আয় করেছে।
আর ‘মণিচিত্রথাঝু’ দুই মুক্তির সময়েই বক্স অফিসের রেকর্ড ভেঙেছে।
আবার সিনেমার সিক্যুয়েল তৈরি হলে সেটাও কাজে দেয় জানিয়ে নাহতা বলেন, ২০০১ সালে সানি দেওলের ‘গদর’ বক্স অফিস নাড়িয়ে দেয়। গত ব্ছর এর সিক্যুয়েল মুক্তির পরও ইতিহাস তৈরি করেছে।
আবার উল্টো উদাহরণও আছে। নাহতা বলেন, ১৯৯৬ সালে দক্ষিণী তারকা কমল হাসানের ‘ইন্ডিয়ান’ ভালো ব্যবসা করলেও গত মাসে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার সিক্যুয়েল সবাইকে হতাশ করেছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, পুরনো সিনেমাগুলোর ঠাঁই হয়েছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোয়। সেখানে দেখা বাদ দিয়ে, এই সিনেমাগুলো আবার যখন প্রেক্ষাগৃহে আসছে, তা দেখতে দর্শকরা এত উৎসাহী কেন?
তরণ আদর্শ জবাবে বলেন. “অনলাইন এবং থিয়েটারের পর্দায় সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আলাদা। দুটো তুলনাই করা যায় না। এজন্য দর্শক এখনো তাদের পুরনো প্রিয় কোনো সিনেমা হলে এলে দেখতে ভিড় করেন।”
তরণ আদর্শের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে পুনের ৩০ বছর বয়সী শ্রুতি জেন্ডে একমত। তিনিও বেশ কয়েকটি পুরনো সিনেমা দেখেছেন।
“প্রেক্ষাগৃহে আপনি এমন কিছু দর্শকের দেখা পান যারা সত্যি সেই সিনেমাগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতে আসেন। দর্শকরা কোনো দৃশ্য বা সংলাপ শুরুর আগেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেন। কারণ তারা জানেন এরপর কি আসতে চলেছে।”
তাই বলে নতুন সিনেমা নিয়ে আগ্রহ নেই তা নয়।
শ্রুতি বলেন, "আমি বছরে একটি বা দুটি পুরনো সিনেমা দেখতে পারি। কিন্তু তার পরেও আমি একটি নতুন ভালো সিনেমা দেখতে চাই।"