“মানি বা না মানি আস্তে-ধীরে ই-বুক কাগজের বইয়ের সমান পর্যায়ে চলে আসবে। তবে কাগজের বই হারিয়ে যাবে না," বলছেন জাফর ইকবাল।
Published : 26 Feb 2023, 11:41 PM
বহনের ঝক্কি না থাকায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে ই-বুক, আর পড়তে না চাইলে শোনার জন্য তৈরি হচ্ছে অডিও বুকও। অমর একুশে বইমেলায় ছাপা বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে ই-বুক ও অডিও বুকের কয়েকটি স্টল।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বর্ধমান হাউসের পাশে আছে 'বইঘর' নামে একটি ই-বুক প্রতিষ্ঠানের স্টল। সেখানে কথা হল স্টলটির ব্র্যান্ড প্রমোটর নুরজাহান ইতুর সঙ্গে। তিনি বললেন, “এখানে ৩ হাজারের বেশি বই রয়েছে।”
কিন্তু ‘ফাঁকা’ এই স্টলে বই কোথায়? চোখ গেলো ছোট্ট একটি ডিভাইসের দিকে। ‘বইঘর’ অ্যাপে ক্লিক করতেই একে একে দেখা গেল বইগুলো।
এই অ্যাপে গিয়ে পাঠক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করে পড়ে ফেলতে পারবেন প্রিয় বইগুলো। চাইলে ডাউনলোড করেও সংগ্রহে রেখে দিতে পারবে বলে জালেন ইতু।
তিনি বলেন, "আমাদের বইঘর অ্যাপে ই-বুক পড়ার পাশাপাশি অডিও বুক রয়েছে। কেউ চাইলে শুনে নিতে পারবেন প্রিয় বইটি। এর জন্য সাবস্ক্রাইব করতে হবে। ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২৯৯ টাকার প্যাকেজ রয়েছে।
“২৯৯ টাকার প্যাকেজটিতে প্রতি মাসে ১৫টা বই ডাউনলোড করা যাবে। আর ১৪৯ টাকার প্যাকেজে শুধু ই-বুক পড়তে পারবেন। কোনো লাইন ভালো লাগলে হাইলাইট করে রাখা, কালার পাল্টানোও যাবে।”
বইঘর প্রকাশ করেছে কথাসাহিত্যিক মধুমিতা চক্রবর্ত্তীর স্মৃতিকথাধর্মী বই 'খেলা ভাঙার খেলা'। শুক্রবার সন্ধ্যায় বইঘর স্টলে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও বাংলাঢোল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হক।
ই-বুকের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, "ই-বুক আমাদের দেশে নতুন শুরু হয়েছে। আমরা স্বীকার করি বা না করি, মানি বা না মানি আস্তে-ধীরে ই-বুক কাগজের বইয়ের সমান পর্যায়ে চলে আসবে। তবে কাগজের বই হারিয়ে যাবে না।"
জাফর ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "গাড়িতে বসে কেউ কানে হেড ফোন লাগিয়ে প্রিয় বইটির পাঠ শুনছে কিংবা মোবাইকে বইটি পড়ছে, সেটা তো অবশ্যই ইতিবাচক।
“কিন্তু আমি মনে করি, আগামী ১০০ বছরেও ছাপা বইয়ের আবেদন নষ্ট হবে না। ছাপা বই থাকবে, পাশাপাশি ই-বুক আমাদের পাঠ-অভ্যাসে নতুনত্ব আনবে।"
একাডেমি প্রাঙ্গণে রয়েছে ‘সেই বই’ নামে আরেকটি ই-বুক স্টল। সাড়ে ৪ হাজারের বেশি বই, ১৪০০ জনের বেশি লেখক, ৬ শতাধিক ফ্রি বই রয়েছে তাদের অ্যাপে। ৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা খরচ করে পড়া যাবে বেশিরভাগ বই। কিছু বই আছে ৬০/৭০ টাকার সাবস্ক্রিপশন ফি।
'সেই বই'র ব্র্যান্ড প্রমোটর কানিজ ফাতেমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইয়ের প্রকাশক বা লেখকের যার নামে স্বত্ব থাকে, তার সাথে চুক্তির মাধ্যমেই বইটি আমাদের এখানে পাঠকের জন্য দেওয়া হয়। “লেখক বা প্রকাশক ৭০% পায়, আমরা ৩০% নিয়ে থাকি। প্রতিটা বইয়ের জন্য এককালীন পেমেন্ট করতে হয়। সাবস্ক্রাইব করার জন্য কোনো ফি নেওয়া হচ্ছে না।”
এতে লেখক বা প্রকাশকও লাভবান হচ্ছেন বলে জানান কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, "লেখক বা প্রকাশক কমিশন পাচ্ছেন। ফলে আর্থিকভাবে লেখক লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।”
ধানসিঁড়ি ডিজিটাল মাস ছয়েক আগে গড়েছে 'বই চিত্র' নামে আরেকটি প্লাটফর্ম। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড প্রমোটর রাকিবুজ্জামান মাসুদ বলেন, “এটি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত। আমাদের অ্যাপে সাবস্ক্রিপশন ফ্রি। ২টা অডিও বুক আছে এবং ই বুক আছে ১৮টার মতো। আমাদের অ্যাপে ঢুকে স্ক্রিনশট বা ডাউনলোড করা যাবে না। শুধু পড়া যাবে।"
অডিও বই নিয়ে 'কাব্যিক' নামে একটি প্লাটফর্মের স্টল রয়েছে একাডেমির পুকুর পাড়ে। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড প্রমোটর ফয়সাল বিন হাশেম বলেন, “আমাদের অ্যাপে ১ হাজারের বেশি বই আছে, যার সবগুলো অডিও বুক। বাতিঘর, আহসান পাবলিকেশন্সসহ ১০টার বেশি প্রকাশনার সাথে আমরা চুক্তি করে বই নিয়েছি চুক্তি। ১ বছরে আরও ১ হাজারের বেশি বই নিয়ে আসব।”
দেশি-বিদেশি বই পড়ার সুযোগ থাকছে জাকিয়ে ফয়সাল বলেন, “প্রতি মাসে ৫০ টাকা সাবক্রিপশন ফি, বইমেলায় ১ টাকায় সাবস্ক্রাইব করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ফ্রি বুকও আছে। আবার বিজ্ঞাপন দেখার মাধ্যমেও বই শুনতে পারবে পাঠক।
“আর ৫০ টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করলে বিজ্ঞাপনমুক্ত বই শুনবে। বাচ্চাদের বই আছে এনিমেশনসহ। বাচ্চাদের বই শোনা এবং দেখার মাধ্যমে পড়ার সুযোগ রয়েছে।”
‘শুনুন যখন যেখানে খুশি’ স্লোগান নিয়ে 'শুন ই' নামেও রয়েছে একটি অডিও বুক শপ। মূলত প্রচার চালাতেই মেলাতেই এসেছে তারা।
লেখক অভিজিৎ রায় স্মরণ
বইমেলায় টিএসসি গেট দিয়ে প্রবেশ পথের পাশেই যে জায়গায় আক্রান্ত হয়েছিলেন লেখক অভিজিৎ, সেই স্থানে রোববার সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বালন করে এবং ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান নিয়ে একটি আলোর মিছিল টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত যায়।
অভিজিৎ রায়ের ছোট ভাই অনুজিৎ রায় বলেন, “যে আদর্শকে ধারণ করে অভিজিৎ রায় জীবন দিয়েছেন, সেই আদর্শকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। মুক্তচিন্তার পথকে রুদ্ধ করা যাবে না। মানুষকে জেগে উঠতে হবে।”
এ সময় উপস্থিত ছিলেন রবিন আহসান, অপরাজিতা সঙ্গীতা, এফ এ শাহীনসহ অনেকে।
২০১৫ সালের একুশের বইমেলায় দুটি বই প্রকাশ হয় অভিজিতের, সে কারণেই স্ত্রী বন্যা আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে তিনি দেশে আসেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলায় এক অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে হামলার শিকার হন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে প্রকাশ্যে অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান তার স্ত্রী। সেই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন সৃষ্টি করে।
নতুন বই
রোববার ২৬তম দিনে মেলা শুরু হয় বিকাল ৩টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এ দিন নতুন বই এসেছে ১৫৫টি।
বইমেলায় কারুবাক প্রকাশনী এনেছে তৌহিদ সিজারের লেখা উপন্যাস ‘আদাভান’। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র’র নাম ‘আদাভান’, যাকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন ঘটনা উন্মোচিত হতে থাকে।
নানা অনুষ্ঠান
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সাহিত্যের বৈভব ও জেলা সাহিত্যমেলা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইমন জাকারিয়া। আলোচনায় অংশ নেন মুন্সি আবু সাইফ, সাহেদ মন্তাজ ও মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
এ দিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন সোহেল আমিন বাবু, হরষিত বালা, আসাদুজ্জামান আসাদ, মাহফুজা অনন্যা ও মোহাম্মদ আলমগীর আলম।
সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন মালেক মাহমুদ, সালাউদ্দিন বাদল, শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও আলমগীর আলম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ম ম জুয়েল, সাফিয়া খন্দকার রেখা, ফয়জুল আলম পাপ্পু, শামস মিঠু ও ফারজানা ইসলাম।
এছাড়া ছিল দিলরুবা খানমের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘শব্দনোঙর’, ফরিদা পারভীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অচিন পাখি’, অনিকেত আচার্যের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’, ড. শামীম মতিন চৌধুরীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিউটিফুল মাইন্ড’র পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া, ফেরদৌস আরা, জেরিন তাবাসসুম হক, নয়ন বাউল, দেলোয়ার হোসেন বয়াতি ও আমজাদ দেওয়ান। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন কাজী ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), মো. আতিকুল ইসলাম (বাঁশি) শেখ জালালউদ্দিন (দোতারা) ও মো. হাসান মিয়া (বাংলা ঢোল)।
সোমবার যা থাকছে
২৭তম দিনে মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ববাঙালির সাহিত্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আলম খোরশেদ। আলোচনায় অংশ নেবেন এ এফ এম হায়াতুল্লাহ, আ-আল মামুন, জসিম মল্লিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।