যুদ্ধের বাজারে ৬% মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কতটা বাস্তবসম্মত

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার বিষয়টিকে বাজেটে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ইউক্রেইন যুদ্ধ থামবে কি না, তার ওপর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 10:42 AM
Updated : 1 June 2023, 10:42 AM

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন, বাস্তবতার সঙ্গে তার খুব একটা মিল পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার বিষয়টিকে বাজেটে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ইউক্রেইন যুদ্ধ থামবে কি না, তার ওপর।

বৃহস্পতিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিনি।

এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি ওই লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন, যখন ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে চলতি অর্থবছরের দশ মাসেই গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি উঠে গেছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচককে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা সংশোধন করে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি।

অর্থবছরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই দেশের বাজারে ছিল ভোক্তাদের হাহাকার। একক মাসের হিসাবে এক যুগের রেকর্ড ভেঙেছে মূল্যস্ফীতির পারদ। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের দশ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

সরকার যখন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করল, তখনও ইউক্রেইন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশে চলছে মন্দার পদধ্বনি। সে প্রসঙ্গ ধরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই লক্ষ্যমাত্রায় ‘বাস্তবতার সঙ্গে কিছুটা অমিল’ রয়েছে।

“সরকার হয়ত আগামী অর্থবছরে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিম্বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এই রকম একটা আশা থেকে এই লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে। এখনই সরকার পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো পরিকল্পনায় নিতে পারত।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে এই গবেষক বলেন, “সারা বিশ্বেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। বৈশ্বিক ঘটনার কারণে এখানে সরকারের ব্যর্থতা দাবির খুব সুযোগ নেই। তাই মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নির্দিষ্ট একটা জায়গায় ধরে রাখাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ।”

তারমতে, খাদ্য মূল্য যেহেতু মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করে, সেহেতু বাজারে খাদ্য পণ্যের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সরকার আশাবাদী হয়ে ইতিবাচক কিছু করতে চাইলে সেটা খারাপ নয়। বরং আশাবাদী কর্মকাণ্ডই ইতিবাচক ফল বয়ে আনে।

“সরকারের এই আশাবাদী এবং ইতিবাচক মনোভাবকে আমি ভালো মনে করি। আমি মনে করি উন্নত বিশ্ব তাদের নিজেদের স্বার্থেই ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবে। এই যুদ্ধের কারণে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে তার নিজের অর্থনীতি রক্ষা করতেই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবে।”

তাই গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৬ শতাংশ ধরায় দোষের কিছু দেখছেন না মন্তব্য করে বিনায়ক সেন বলেন, যুদ্ধ বন্ধ করা গেলে মূল্যস্ফীতি ওই মাত্রার মধ্যেই রাখা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘাটতির দিকে।

তিনি বলেন, ওই ঘটতি মেটাতে সরকার যদি বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতিতে বেশি প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তাতে ব্যক্তি খাত ঋণ কম পাবে।

“আবার যদি সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে সরকার টাকা নেয়, সেটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। সুতরাং আমি বলব এবারের বাজেট বাস্তবায়ন হবে ভেরি ডিফিকাল্ট।”