গরিবের কথা বলে ভর্তুকি, সুবিধা পায় ধনী: আহসান মনসুর

“কারা সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে? ধনীরা। কারা বেশি পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহার করে? ধনী মানুষেরা।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2023, 12:44 PM
Updated : 5 March 2023, 12:44 PM

‘গরিবের কথা বলে’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তার সুফল ধনীরাই বেশি পায় বলে মনে করেন অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা মনে করেন, এসব খাতে ভর্তুকি বন্ধ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের সরাসরি ‘কিছু’ দেওয়া উচিত। এতে তারা উপকৃত হবে। 

রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ এর সূচনা পর্বে কথা বলছিলেন আহসান এইচ মনসুর। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং ফেইসবুকে (https://www.facebook.com/bdnews24) অনুষ্ঠানটি লাইভস্ট্রিম করা হয়। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের ‘শঙ্কা’ আসলে কতটুকু, নীতি নির্ধারণে কোথায় ‘ভুল’ ছিল, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, মুদ্রা পাচার, আইএমএফের ঋণ ও তাদের শর্ত, সংকট উত্তরণে কী কী করা উচিত ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। 

আইএমএফ থেকে সরকার ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে। ধাপে ধাপে ২০২৬ সালের মধ্যে আসবে পুরো অর্থ। এরই মধ্যে পাওয়া গেছে ৪৭ কোটি ডলার। 

এই ঋণের নানা শর্তের মধ্যে আছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভর্তুকি প্রত্যাহার এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বা উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে মিল রেখে দাম সমন্বয়। 

সরকার গত দুই মাসে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিবার বেড়েছে পাঁচ শতাংশ হারে। 

ভর্তুকির সুবিধা যেভাবে ‘ধনীদের পকেটে’ 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এই যে ভর্তুকি, তার সুফল কারা পাচ্ছে, এমন প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমি মনে করি এটার (ভর্তুকির) উপকারভোগী হচ্ছে ধনীরা। তারা সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ, সবচেয়ে বেশি জ্বালানি, সবচেয়ে বেশি পাইপলাইনের পানি ও গ্যাস ব্যবহার করে। 

“তাহলে আপনি কেন দরিদ্রদের লাভবান হওয়ার কথা বলছেন? এটা গরিবদের জন্য নয়। গরিবদের সরাসরি কিছু দিন, যা তাদের বেশি উপকার করবে।” 

আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে কাজ করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা সংস্থায়। তিনি এর নির্বাহী পরিচালক। ভর্তুকির সুবিধা কীভাবে ধনীরা বেশি পায়, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “কারা সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে? ধনীরা। কারা বেশি পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহার করে? ধনী মানুষেরা। পুরো দেশের মানুষ এলজিপির ‍উপর নির্ভর করছে, যার দাম প্রতি সপ্তাহে পরিবর্তন হয়। এবং এটা ভালোমতো চলছে। কেউ কাউকে দোষারোপ করছে না। তাহলে সরকার কেন এটার (পাইপলাইনে গ্যাস) দাম স্থির রেখে নিজের ঘাড়ে দোষ নিচ্ছে?”  

‘জ্বালানির ধাক্কা’র পেছনে ‘বিনিময় হার’ 

আহসান মনসুর মনে করেন, বছরের পর বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ধরে রাখার সরকারের নীতির কারণে এখন বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেকটাই বাড়াতে হয়েছে। 

তিনি বলেন, “মুদ্রা বিনিময় হার আমাদের জন্য বড় সমস্যা, কারণ ডলারের অব্যাহত সংকটের মুখোমুখি আমরা এবং এটা এখনো চলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সংকট থাকবে, ততক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হবে না। ফলে আমাদেরকে ডলার সমস্যার সমাধান করতে হবে। 

“ডলারের দাম গত প্রায় এক দশক স্থির রাখার কারণে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিনিময় হার স্থির রাখা ভালো কিছু না। আমরা অনেক বলেছি, কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শক্তিশীল মুদ্রা, মানে শক্তিশালী অর্থনীতির ধারণার ‍উপর। 

“আমরা মুদ্রা বিনিময় হার স্থির রেখেছি এবং জ্বালানির দামও স্থির রাখা হয়েছে কয়েক বছর। এ কারণে ঘটনাক্রমে যখন দাম বাড়ানো হচ্ছে, তখন পরিমাণ বড় হয়ে যাচ্ছে।” 

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা টাকার অবমূল্যায়ন করেছি ২৫ শতাংশ। কিন্তু গ্যাসের দাম ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং ধাক্কাটা অনেক বড়। 

“এটা এমন হয়ে গেছে, আমি খুব গরম আবহাওয়া থেকে ঠাণ্ডা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছি, আমার ঠাণ্ডা লেগে গেছে।” 

এ কারণে অর্থনীতি ‘কঠিন ধাক্কার’ মুখে পড়েছে মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, “কোম্পানিগুলোর হিসাবের খাতায় এর প্রভাব পড়েছে, কারণ তারা ডলারে ধার নিচ্ছিল এবং হুট করে তার দাম বেড়ে গেল। 

“আমাদের ভোক্তা আচরণে প্রভাব পড়েছে। কারণ, আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দাম ও গ্যাসের দামের সঙ্গে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন তাবেড়েছে অনেক বেশি হারে। 

“যদি ১ টাকা, ২ টাকার মত করে আস্তে আস্তে এবং ক্রমান্বয়ে বাড়ত, তাহলে আমরা এখন যে পর্যায়ে এসেছি, সেই পর্যন্ত সমন্বয় করতে পারতাম। এমনকি দাম ভবিষ্যতে আরও বেশিও হতে পারত আর সমন্বয়টা হয়ে যেত স্বাভাবিক গতিতে।” 

তিনি বলেন, “আমাদের নীতিনির্ধারকেরা, বিশেষ করে নীতি প্রণয়নের মূল দায়িত্বে থাকা আমলারা এক ধরনের সহজে চলার মানসিকতা নিয়ে আগান।… কিন্তু বিশ্ব এভাবে চলে না, আমাদেরও উচিত হবে না এভাবে চলা।” 

আহসান মনসুর বলেন, “আমরা এখনো সেই মানসিকতার মধ্যেই আছি। বিনিময় হার বেড়েছে। ৮২-৮৩ টাকা থেকে ১০৫ টাকায় নিয়েছি, আবার সেটাকে নির্দিষ্ট রেখে দিয়েছি। আমরা কতদিন ১০৫ টাকায় নির্দিষ্ট রাখব তা এখনও জানি না। নীতিগতভাবে সরকারের অবস্থান হচ্ছে এটা ফ্লেক্সিবল থাকবে, কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? না, এটা হচ্ছে না।”