বাজারভিত্তিক সুদহার ও মুদ্রানীতির কাঠামোতে ‘মনিটারি টার্গেটিং’ এর জায়গায় ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ দিকে সরে আসার কথা আগেই বলে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।
Published : 18 Jun 2023, 12:04 PM
উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে বাজারে মুদ্রা সরবরাহের ছক সাজিয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার রোববার বিকাল ৩টায় অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন, যা নানা কারণে অর্থনীতিবিদসহ নীতিনির্ধারকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কার-পরামর্শের যে ছাপ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উঠে এসেছে, তার অংশ হিসেবে মুদ্রানীতির কাঠামোই এবার বদলে যাওয়ার আভাস বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
সেই সংস্কারের পথ ধরে মুদ্রানীতির প্রথাগত কাঠামোর খোলনলচে এবার বদলে যাবে। বাজারে মুদ্রা সরবরাহের যে পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা বদলে গিয়ে সুদহার কেন্দ্রীক হবে।
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ উত্তরণে আগামী ছয় মাসের মুদ্রানীতি ‘সংকুলানমুখী’ করার পরামর্শ এসেছে চলতি জুন মাসে শেষ হতে যাওয়া মুদ্রানীতির পর্যালোচনায়। সংকটকালীন পরবর্তী সময়েও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে সেখানে।
জানুয়ারি থেকে জুন– এই ছয় মাসের মুদ্রানীতির বিভিন্ন প্রক্ষেপণ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত মুদ্রানীতির রিভিউয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, মুদ্রানীতি ও আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মূল্যায়ন করা হয়েছে।
‘মনিটরি টার্গেটিং’ এর বদলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ ঠিক করার মত পরিবর্তনের সঙ্গে বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া, সুদহার সীমা তুলে দেওয়া এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি চালু করার মত নতুন সিদ্ধান্তের ঘোষণা থাকবে নতুন মুদ্রানীতিতে।
তাতে প্রচলিত মুদ্রানীতির কাঠামো বদলে বাংলাদেশে শুরু হতে যাচ্ছে ভিন্ন ধারার এক মুদ্রানীতি, যা আন্তর্জাতিক পদ্ধতির সঙ্গে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে।
জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতির পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে মুদ্রা সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে সুদহার বাড়ানো, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি, বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসায় অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার বেশি কমেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত মে মাস শেষে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এপ্রিল মাসের ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার ধরে মুদ্রানীতির পর্যালোচনায় এ মূল্যায়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি না কমার ব্যাখ্যায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে পণ্যমূল্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিনিময় হারে টাকার মান সামান্য কমে গেলেও উৎপাদন ব্যয় এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এখনো উর্ধমুখী রয়েছে।
গত এপ্রিল শেষ বৈদেশিক লেনদেনে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চার সূচকের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি এবং চলতি হিসাব ভারসাম্যের ঘাটতি দশ মাসের হিসাবে কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু ওভারঅল ব্যালেন্স ও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি বড় হতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আর্কষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত অগ্রগতি নির্ভর করছে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর অবস্থানের ওপর। সেই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি প্রলম্বিত সংকুলানমুখী মুদ্রানীতির আবশ্যিকতা দেখা দিয়েছে।
অর্থমন্ত্রীও তার বাজেট বক্তৃতায় রিজার্ভ, বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার ও লেনদেন ভারসাম্যের মত প্রধান প্রধান সংকটের কথা জানিয়েছিলেন। এর সমাধানে আইমএফের পরামর্শের আলোকে আর্থিক খাতের সংস্কারের কথা ছিল বাজেটের পরতে পরতে।
সেই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার প্রথম আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ হচ্ছে মুদ্রানীতির কাঠামোতে পরিবর্তন আনা।
বাজেট প্রস্তাবেও সে কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বাজারভিত্তিক সুদহার ও মুদ্রানীতির কাঠামোতে ‘মনিটারি টার্গেটিং’ এর বদলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ করা হচ্ছে।
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী কামাল। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে বেঁধে রেখে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে সেখানে।
২ জুন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও দেশীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনার চিন্তা-ভাবনা করছে।
“মুদ্রানীতির কাঠামোতে অধিকতর স্বচ্ছতা ও নমনীয়তা আনতে এবং মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা বিবেচনায় ‘মনিটরি টার্গেটিং’ এর স্থলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ এর দিকে সরে আসার চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া সুদের ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার কাজ চলছে।“
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুদ্রানীতির বর্তমান কাঠামোতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করা হয়। অর্থনীতির আকার বড় হওয়ায় এটি সেভাবে আর কাজ করছে না।
“এখন বাজারে মুদ্রা সরবরাহের চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে বাজারভিত্তিক সুদহার নীতিকে। বাজারভিত্তিক হওয়ায় সুদহার প্রয়োজনে ওঠা-নামা করবে।”
গত বছরই আইএমএফ এর কাছ থেকে সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ আসে। গত ফেব্রুয়ারিতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশ পাওয়ার সময়ও সে পরামর্শ অব্যাহত থাকে।