আমদানি নিয়ন্ত্রণের বিধিনিষেধ আরও কিছুদিন চায় বাংলাদেশ ব্যাংক

মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2023, 02:40 PM
Updated : 1 April 2023, 02:40 PM

দীর্ঘদিন থেকে অস্থির বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; টাকার মানে আরও অবনতি ঠেকাতে এমন পদক্ষেপের পরামর্শ এসেছে।

একই সঙ্গে অর্থনীতির সাম্প্রতিক হালচাল বিশ্লেষণ করে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাকে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 ‘মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত প্রতিবেদনে’ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক সংস্করণে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ, নির্বাচিত সূচকগুলোতে পরিবর্তনের প্রভাবের কথা উল্লেখের পাশাপাশি সমাধানে বেশ কিছু সুপারিশ করে।

দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়া, টাকার মান হারাতে থাকা, বাংকিং খাতে তারল্যের সংকট, সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাওয়া, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাবের মত সামষ্ঠিক অর্থনীতির সূচকের তথ্য বিশ্লেষণের পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে।

ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ও মুদ্রা বিনিময় হারে টাকার মান পড়ে যাওয়ায় যে চাপ তৈরি হচ্ছে তা কমিয়ে আনতে দেশে উৎপাদন বাড়াতে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে যেতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ইউক্রেইন যুদ্ধের পর বাড়তে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামাল দিতে খরচ কমিয়ে আনতে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপসহ বেশ কিছুদিন থেকে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে চলতি অর্থবছরের ছয় মাস শেষে গত ডিসেম্বরে আমদানি ব্যয় সাত বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। নতুন এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমে সাড়ে ৫ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে সরকারের একটি সদিচ্ছা। বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নেই। এটি ফিরিয়ে আনতে পারলে সব উদ্যোগই কার্যকর হবে।’’

মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ

বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে। বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালের জুনে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বরে ৯ শতাংশ ছাড়ায়। এরপর তা ক্রমান্বয়ে কমে ফেব্রুয়ারিতে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, “গড় মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাটাই বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতি কর্তৃপক্ষসমূহকে সমন্বিতভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।’’

তবে শুধু রাজস্ব নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগে দ্রুত কোনো ফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিনা শেখ।

Also Read: ছয় মাস কমার পর বাড়ল মূল্যস্ফীতি, প্রতিমন্ত্রী বলছেন ‘স্বাভাবিক’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘রাজস্ব নীতির মাধ্যমে শুল্ক কমালেই যে পণ্যের দাম দ্রুত পড়ে যাবে- তা কিন্তু হবে না। কারণ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির কাঠামোটা সেভাবে সুগঠিত হয়নি যে, রাজস্ব নীতিতে কোনো উদ্যোগ নিলে তার প্রভাব বা ফল অন্য খাতে দ্রুত পাওয়া যাবে।’’

এরপরও উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “দেরিতে হলেও যাতে কিছুটা সুফল মেলে। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি সমন্বিতভাবে চললে সুবিধা আছে। সেই সুবিধা পেতে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ প্রতিটি খাতের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকতে হবে।’’

ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে অর্থ দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহারের ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে সম্প্রতি ভোক্তা ঋণে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ বাড়িয়ে সুদ নিতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে অধ্যাপক হাসিনা বলেন, সুদের হার তুলে দেওয়া নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব আসতে পারে। এরকম আরও উপায় বের করতে জোর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

খেলাপিঋণ কমানো ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের পরামর্শ

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমাতে রেমিটেন্স বাড়াতে সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ। একই সঙ্গে প্রতিবেদনটিতে রপ্তানি আয় বাড়াতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের পরামর্শ দিয়েছে। প্রচার ও প্রসারে উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগাতে বলেছে।

প্রতিবেদনে তারল্য সংকট সমাধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিতে সজাগ দৃষ্টি রাখার কথা বলা হয়েছে।

ঋণ আদায়ে গঠিত ‘স্পেশাল মনিটরিং সেল’ এর কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করতেও বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ঋণ যাতে ভুল খাতে না যায় ও ঋণের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে পূরণ হয় সেজন্য মঞ্জুর করা ঋণের অর্থ একেবারে না দিয়ে ব্যবহার সাপেক্ষে ধাপে ধাপে বিতরণ করতে গুরুত্ব দিতে বলেছে। এতে ঋণের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা কমে যাবে এবং ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে।