নানা সময়ে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হলেও তেমন উদ্যোগ দেখতে না পাওয়ার কথা বলেছেন অর্থনীতির গবেষক সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, “যে পরিমাণ রিজার্ভ বা ডলার দেশে আসার কথা ছিল, বিদেশি বিনিয়োগ আসার কথা ছিল সেটা তো আসছে না। অর্থনীতি ভালো দিকে যাওয়ার পথগুলো আমরা সংকুচিত করে দিচ্ছি। টাকা যেগুলো পাচার হচ্ছে সেগুলো ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়; কিন্তু টাকা পাচার রোধ করার জন্য তেমন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।”
বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: উদ্বেগের জায়গা ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে বক্তব্য রাখছিলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম।
প্রভাবশালী মহলের অপতৎপরতায় দেশের অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সানেমের পক্ষ থেকে আমরা আগেও বলেছিলাম, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা পরের হিসাব। আগে টাকা পাচার কীভাবে থামানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। অনেক প্রভাবশালী লোক তারা, পাচারকারীরা নিজেদের মধ্যে খুবই শক্ত জোট গঠন করে আছে। চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
“এভাবে যদি অর্থনীতির রক্তক্ষরণ চলতে থাকে, দুর্নীতি চলতে থাকে, টাকা পাচার হতেই থাকে, কর্মসংস্থান যদি না বাড়ে, বিনিয়োগ যদি না হয় তাহলে অর্থনীতি তো অবশ্যই খারাপের দিকে যাবে। এ ধরনের রক্তক্ষরণ অর্থনীতির উন্নতির অনেক সম্ভাবনা, বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে।“
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “এ মুহূর্তে অর্থনীতির বড় একটা সংকটের জায়গা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। সানেম প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৩০০ পোশাক শ্রমিকের জীবনযাত্রার তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে- এসব শ্রমিকদের পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।”
গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল; এরপর তা কমতে কমতে এখন ৩৪ বিলিয়নে নেমেছে। বিনিয়োগ আকারে কিছু রিজার্ভ খরচ হওয়ায় প্রকৃত স্থিতি এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে।
এই পরিস্থিতিতে সরকার জ্বালানি থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার পাশাপাশি খোলা বাজার থেকে গাস আমদানি বন্ধ রেখেছে। এর প্রভাবে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়ে রপ্তানিও কমে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এ সংকটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাওয়ার কারণে খাবারের তালিকা সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই।
অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে গবেষক সেলিম রায়হান বলেন, “একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, অন্যদিকে আমদানি রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা যেভাবে বেড়ে গিয়েছিল তা এখনও কমে সুখকর পর্যায়ে আসেনি। আমদানি এখনও কমেনি, এলসি ওপেনিং কিছুটা কমলেও এর প্রভাব বুঝতে আরও কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।
“দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিবর্তে এখনও আমরা স্বল্প মেয়াদি ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকে আছি। সরকারি ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেসরকারি ঋণ দিনে দিনে বাড়ছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে আসছে।”
ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা তুলে ধরে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, “নিজস্ব উপায়ে আমাদের কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়ে আছে। সেগুলো হচ্ছে- কর রাজস্ব আহরণ থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের মন্দ ঋণ, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে স্বল্প ব্যয়, সামগ্রিক অর্থনীতির তুলনায় বাজেটের আকার ছোট হয়ে থাকা। এখানে অনেক পলিসি প্যারালাইসিস রয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সংস্কারের যে বিষয়গুলো উঠে এসেছিল তার তেমন প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।”
সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা খাদ্য সঙ্কটের ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের জন্য সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়াতে হবে। মধ্যবিত্তদের অনেকেই এই সময়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সারিতে ভিড় জমাচ্ছে। নবাগতদের জন্যও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়াতে হবে।
“দ্বিতীয়ত সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষয় থামাতে হবে। এর বাইরে প্রয়োজন মতো স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের দিকে যেতে হবে। যেমন- ব্যাংকঋণের সুদহার, ডলারের বিনিময় হার, এগুলোতে সংস্কার করতে হবে।”
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দেশের মোট কর্মশক্তির ৮৫ শতাংশকেও সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির আরেক অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেন, “দেশে এখনও নির্ভরযোগ্য তথ্য উপাত্তের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বিবিএস চাহিদামত তথ্য উপাত্ত হাজির করতে পারছে না।”
চলমান পরিস্থিতিতে সামাজিক সুরক্ষার কবচগুলো আরও বিস্তৃত ও কার্যকর করার আহ্বান জানান তিনি।