৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি আরও ১০০ কোটি ডলার করে সহায়তা দিতে পারে।
Published : 04 Feb 2023, 05:05 PM
অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ পাচ্ছে, তা সংকট মোকাবিলায় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে বলে অর্থনীতিবদদের একটি সম্মেলনে মত প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঋণ অনুমোদনের পর বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকেও সহায়তা আসবে বলে ধারণা তাদের।
এতে অংশ নিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, আইএমএফের ঋণ দেয়ায় অন্য দাতা সংস্থাগুলোও এখন এগিয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফ যে শর্তগুলো দিয়েছে, সেগুলোও দেশের জন্য ভালো হবে বলেই বিশ্বাস তার।
আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি জমা পড়ার দুই দিন পর শনিবার ঢাকায় মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।
দুই দিনের সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দেড়শ অর্থনীতিবিদ অংশ নিচ্ছেন।
অর্থনৈতিক এই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে সরকার যে ঋণ নিচ্ছে, সেটি দেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলেও মনে করেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আইএমএফ আমাদের আর্থিক খাতে যেসব সংস্কার প্রস্তাব করেছে সেগুলো যৌক্তিক। তাদের (আইএমএফ) পরামর্শে আর্থিক খাতে ধারাবাহিক সংস্কার করা হচ্ছে। এসব প্রস্তাব আমরা ইতিবাচকভাবে নেওয়ায় এখন অন্যান্য দাতা সংস্থাও ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে।”
বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো গত একটি বছর কঠিন যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্যও। বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যতে আরও বেশি প্রভাব, ডলার সংকট, রিজার্ভের ক্রমাগত পতন, প্রবাসী আয়ে ভাটা, ইত্যাদির কারণে গত এক যুগের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই পরিস্থিতিতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চাইলে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি বিজ্ঞপ্তিতে জানায় আইএমএফ। দুই দিন পরেই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার জমা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে।
বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকেও সরকার নতুন করে ঋণ চাইছে। ২০২৩ সালে সব মিলিয়ে ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছিল। এখন এই বাজেট সহায়তার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে বলে আভাস মিলেছে।
গত বছরের মে মাসে এডিবির কাছে ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। আগামী এপ্রিল মাসে এডিবির বোর্ড সভায় এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পেতে পারে।
আইএমএফের এই ঋণ নিতে সংস্থাটির ৩০টি শর্ত মানতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এর অন্যতম হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানো।
এক মাসের মধ্যে দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, আবাসিক ও পরিবহন ছাড়া অন্য খাতের গ্যাসের দাম আড়াই গুণ করে দেয়ার পেছনে এই শর্তই দায়ী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে শিল্প আর বিদ্যুতের গ্যাসের দর বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে বলে আশঙ্কার কথাও বলাবলি হচ্ছে।
তবে আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য সামনের সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক হবে। এটি সামাজিক ও উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য আরও অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করবে।
আইএমএফের অন্য শর্তের মধ্যে আছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রেও সরকার একমত পোষণ করেছে।
বৈশ্বিক সংকটে দেশের অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবেলা ও উত্তরণের উপায় নিয়েই সানেমের এবারের সম্মেলনে আলোচনা করেন বক্তারা।
দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো, একগুচ্ছ সংস্কারে বাংলাদেশের ভালো দেখছে আইএমএফ
‘আইএমএফ হচ্ছে সরকারের ওস্তাদ, তাদের শর্তে বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম’
প্রথম সেশনে সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “আইএমএফের ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না, বরং টার্নিং পয়েন্ট। এই ঋণ পাওয়ার ফলে এখন অন্যান্য দাতা সংস্থা বাংলাদেশের ব্যাপারে আস্থা পাবে। তাদের কাছে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া সহজ হবে।“
দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে চারটি বিষয়ের উপর জোর দিতে বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
তিনি বলেন, “সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব আঘাত এসেছে সেগুলোর কোনটিতে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, তা খোঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করবে এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে এসব আঘাতের প্রভাব কেমন, তার উপর জোর দিতে হবে।”
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “রিজার্ভের পরিমাণ কত, সেটি বড় কথা না, এর প্রবণতাটা খেয়াল করা গুরুত্বপূর্ণ। এক-দুই বছরে এটি কত কমে যাচ্ছে তা দেখতে হবে। কমে গেলে, তা চলতে দেওয়া যাবে না, একবার কমে যাওয়া শুরু করলে নিয়মনীতির মধ্যে থেকে তা সামাল দেওয়া আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য কঠিন।”
দুই দিনের এই সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দেড়শ অর্থনীতিবিদ অংশ নিচ্ছেন। সম্মেলনে ২৩টি অধিবেশনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অর্থনীতি-গবেষকরা ৮০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।