বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ১৫.৪৩% বাড়ানোর সুপারিশ

ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের বিদ্যমান গড়মূল্য ৭ টাকা ১৩ পয়সা; বিইআরসি তা বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৩ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2023, 09:23 AM
Updated : 8 Jan 2023, 09:23 AM

পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এক মাসের মধ্যে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ইউনিট প্রতি ভারিত গড়ে এক টাকা ১০ পয়সা বা ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কারিগরি কমিটি।

কারিগরি কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ভারিত গড়ে বিদ্যমান খুচরা মূল্য ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৩ পয়সা করা যেতে পারে।  

রোববার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে সঞ্চালন সংস্থা ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের ওপর গণ শুনানি শেষে এ তথ্য জানানো হয়। এক্ষেত্রে এনার্জি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি বিতরণ ব্যয় বৃদ্ধির হিসাব বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলছে বিইআরসি।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের দাম সব পর্যায়ে বাড়ানো হয়। তখন পাইকারিতে দাম ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বেড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা হয়।

ভর্তুকির ভার কমাতে গত ২১ নভেম্বর পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি। এর ফলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করছে ৬ টাকা ২০ পয়সা, যা আগে ৫ টাকা ১৭ পয়সা ছিল।

বাড়তি ওই ১ টাকা ৩ পয়সা থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এনার্জি চার্জ বাবদ আট হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করবে বিদ্যুতের একক বিক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- পিডিবি। এই বাড়তি ব্যয়ের চাপ কমানোর পাশাপাশি বিতরণ ব্যয় বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে খুচরা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে কোম্পানিগুলো।

প্রস্তাবক সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা ছাড়াও বাংলাদেশ হাই টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ও মেট্রোরেল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধিরাও শুনানিতে অংশ নেন। ভোক্তাদের পক্ষে ছিলেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।

ছয়টি বিতরণ কোম্পানির (বাবিউবো, বাপবিবো, ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো ও নেসকো) প্রস্তাব বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে কারিগরি কমিটির সুপারিশে বলা হয়, বিদ্যমান এনার্জি রেট ৭ টাকা ০২ পয়সার সঙ্গে বিতরণ ব্যয় বাবদ ১ টাকা ২১ পয়সা যোগ করা যেতে পারে। এতে খুচরা বিদ্যুতের ভারিত গড় মূল্য দাঁড়াবে ৮ টাকা ২৩ পয়সা, যা এতদিন ৭ টাকা ১৩ পয়সা ছিল।

কমিশনের কারিগরি কমিটির সদস্য মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রতিবেদন আকারে এই সুপারিশ উত্থাপন করেন। এর মধ্যে বাবিউবির খুচরা মূল্য ৮ টাকা ৭৪ পয়সা, বাপবিবোর খুচরা মূল্য ৭ টাকা ৬৩ পয়সা, ডিপিডিসির খুচরা মূল্য ৯ টাকা ৪৩ পয়সা, ডেসকোর খুচরা মূল্য ৯ টাকা ৪১ পয়সা, ওজোপাডিকোর খুচরা মূল্য ৮ টাকা ৫৪ পয়সা এবং নেসকোর খুচরা মূল্য ৮ টাকা ১৬ পয়সা হিসাব করা হয়েছে।

এই সুপারিশের বিবেচনায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বিতরণ কোম্পানিগুলো ৮৮ হাজার ৪১২ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ কিনলেও গড়ে ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ সিস্টেম লসের পর বিক্রি করতে পারবে ৮১ হাজার ৪৯০ মিলিয়ন ইউনিট।

নতুন খুচরা মূল্য নির্ধারণে এই সিস্টেম লস বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, যদিও গত অর্থবছরের প্রকৃত সিস্টেম লস ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাবিউবো ১ টাকা ২৯ পয়সা বিতরণ ব্যয় দাবি করলেও কমিশন সুপারিশ করেছে ৯৯ পয়সা। বাপবিবো ১ টাকা ৮২ পয়সা বিতরণ ব্যয় দাবি করলেও কমিশন ১ টাকা ৪৩ পয়সা সুপারিশ করেছে।

একইভাবে ডিপিডিসির ১ টাকা ৮০ পয়সার প্রস্তাবের বিপরীতে ৯৫ পয়সা এবং ডেসকোর ১ টাকা ৬৩ পয়সার প্রস্তাবের বদলে ৮৬ পয়সা সুপারিশ করেছে কমিটি।

এছাড়া ওজোপাডিকোর ১ টাকা ৫০ পয়সার প্রস্তাবের জায়গায় ১ টাকা ০২ পয়সা এবং নেসকোর ১ টাকা ১৯ পয়সার দাবির জায়গায় ৯২ পয়সা সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে।  

ক্যাবের বিরোধিতা

শুনানিতে উপস্থিত ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম ৫৩টি প্রশ্ন উত্থাপন করে কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়মের তথ্য সামনে আনেন। বিতরণ কোম্পানিগুলোর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বিতরণ ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না বলেও যুক্তি উত্থাপন করেন তিনি।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করেন, ইতোপূর্বে বিভিন্ন শুনানিতে কোম্পানিগুলোর কাছে বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হলেও তারা সেসব তথ্য দিতে পারেনি। কমিশন পরে সেসব তথ্য সরবরাহ করার আদেশ দিলেও তা বিভিন্ন সময় লংঘিত হয়েছে।

আদেশ লংঘনের দায়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জানান, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ক্যাব চাইলে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার এসব তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক শামসুল বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ফলে যে আট হাজার কোটি টাকা খরচ বেড়েছে, তা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপানোর পরিস্থিতি নেই। কারণ বৈশ্বিক মন্দার কারণে ইতোমধ্যে জনগণ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন আয়-ব্যয়ের খাতকে ওঠানামা করিয়েও এই বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করা সম্ভব। কমিশন চাইলে তিনি কোম্পানিভিত্তিক হিসাব করে দেখিয়ে দিতে পারেন।

একই সঙ্গে বিতরণ চার্জ ও সঞ্চালন চার্জও না বাড়িয়ে এক বছরের জন্য কৃচ্ছ্র সাধনের মানসিকতা অর্জন করতে কমিশনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

শুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ও সদস্য মোহাম্মদ আবু ফারুক, মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী, মোহাম্মদ বজলুর রহমান ও মো. কামরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

মেট্রোরেল প্রসঙ্গ

বিদ্যুতের গণশুনানিতে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রসঙ্গও আসে।

বিতরণ সংস্থা ডেসকোর প্রতিনিধি জানান, তারা খুচরা ট্যারিফ অনুযায়ী মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছেন। তবে আরেক বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, মেট্রোরেলের জন্য তাদের আলাদা অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।

মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এখনও তাদের কাছে সংযোগের আবেদন করেনি। তারা সরাসরি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভাগে আবেদন করেছে। আবেদনে তারা পাইকারি দামে বিদ্যুৎ চেয়েছে।

আইন অনুযায়ী মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে ডিপিডিসির কাছে আবেদন করতে হবে এবং তাদেরকে মিটারভিত্তিক খুচরা গ্রাহক হতে হবে বলে ডিপিডিসির পক্ষে থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে বিয়ষটি আমলে নেয় কমিশন।

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, এ বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচলে প্রতিদিন লাগবে ১৮ থেকে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, যা সাধারণ একটি জেলা শহরের দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় সমান।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে মেট্রোরেলের উত্তরা ডিপো ও মতিঝিলে দুটি উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। উভয় উপকেন্দ্রে ১৩২ কিলো ভোল্ট সার্কিটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আসবে।

মতিঝিল উপকেন্দ্রে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) মানিকনগর গ্রিড উপকেন্দ্র থেকে এবং উত্তরা উপকেন্দ্র পিজিসিবির টঙ্গী গ্রিড উপকেন্দ্র ও ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) উত্তরা গ্রিড উপকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকছে।

তৃতীয় উপকেন্দ্রটি মিরপুর শেওড়াপাড়ার মেট্রো স্টেশনে নির্মাণ করা হয়েছে। ডেসকোর পুরাতন বিমানবন্দরের ৩৩ কেভি উপকেন্দ্র থেকে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। বঙ্গভবনের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য স্থাপিত বিশেষ এ উপকেন্দ্র থেকে এ সংযোগ দেওয়া হবে।