বিদ্যুতের দাম সব পর্যায়েই বাড়ল

পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন- তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার; এর ফলে ভোক্তাদের প্রতি মাসে গুণতে হবে বাড়তি টাকা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2020, 10:48 AM
Updated : 27 Feb 2020, 10:48 AM

দুই বছরের বেশি সময় পর বিদ্যুতের এই দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

তবে এই দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক বলে দাবি করেছে ভোক্তা সংগঠন ক্যাব। তারা বলছে, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিরোধিতা এসেছে; বিএনপি এবং বাম দলগুলো এই দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে।

দাম বাড়াতে বিভিন্ন সংস্থার প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানির পর নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্যুৎ ব্যবহারের নতুন হার নির্ধারণের ঘোষণা দেয় বিইআরসি।

সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা।

পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ৪ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতি ইউনিটের দাম হয়েছে ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা।

খুচরা পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জও বিভিন্ন পর্যায়ে ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল জানান, আসছে মার্চ থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার, যা ওই বছর ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

এখন দাম বাড়ানোর পেছনে কী কারণ- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে বিইআরসি চেয়ারম্যান জলিল বলেন, “আমদানি করা কয়লার উপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা হয়েছে, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের উপর ১০ পয়সা করে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বেড়েছে, এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

“পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোকে তুলনামূলক কমমূল্যে অধিক পরিমাণ বিদ্যুত দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কাছে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।”

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই কারণগুলো দেখান তিনি।

বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হলে তার প্রভাবে বিদ্যুতের দাম কমবে বলেই সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছিল। এখন এলএনজি আমদানির পর প্রথমে গ্যাসের দাম পরে বিদ্যুতের দাম বাড়ল।

সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে বার বার সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বিইআরসিকে।

উত্তরে কমিশনের সদস্য রহমান মুরশিদ বলেন, “বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পেছনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ভূমিকাকে বিবেচনায় আনা হয়নি।”

ফাইল ছবি

নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির পর ২৩০/৪০০ ভোল্টের আবাসিক গ্রাহকদের মাসিক বিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবাসিকে লাইফ লাইন গ্রাহকদের এনার্জি চার্জ বাবদ আগের লাইফলাইন গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ১৭৫ টাকার পরিবর্তে এখন গুণতে হবে সর্বোচ্চ ১৮৭ টাকা।

প্রথম ধাপের (০ থেকে ৭৫ ইউনিট) গ্রাহকদের আগের ৩০০ টাকার পরিবর্তে এখন এনার্জি চার্জ বাবদ গুণতে হবে ৩১৪ টাকা, দ্বিতীয় ধাপের (৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট) গ্রাহকদের আগের ১০৯০ টাকার পরিবর্তে এখন গুণতে হবে ১১৪৪ টাকা, তৃতীয় ধাপের (২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের) গ্রাহকদের ১৭১০ টাকার পরিবর্তে গুণতে হবে ১৮০০ টাকা, চতুর্থ ধাপের (৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট) গ্রাহকদের ২৪০৮ টাকার পরিবর্তে গুণতে হবে ২৫৩৬ টাকা, পঞ্চম ধাপে (৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট) গ্রাহকদের ৫৫৮০ টাকার পরিবর্তে ৫৯৬৪ টাকা গুনতে হবে। ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৬৪২০ টাকার পরিবর্তে ৬৮৭৬ টাকা গুণতে হবে।

এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কেমন পড়তে পারে- জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান জলিল বলেন, “আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করি, তার বড় অংশ (৫৮) ভাগ যায় পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোতে। সেই লাইফ লাইন গ্রাহকদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৫ পয়সা।”

ফলে যারা ২১৫ টাকা থেকে ২১৯ টাকা বিল দিতেন, তাদের ২২০ টাকা থেকে ২২৪ টাকা দিতে হবে। মাসিক বৃদ্ধি ১ টাকা থেকে ৫ টাকার মধ্যে।

নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রাহক যারা ৭৫৯ টাকা দিতেন, প্রতি মাসে তাদেরটা বেড়ে হবে ৮০৩ টাকা। যারা ১৯৫২ টাকা বিল পরিশোধ করতেন, তাদেরটা হবে ২০৬৪ টাকা।

কৃষিতে সেচ গ্রাহক যারা তাদের মধ্যে যারা ৩২৬০ টাকা দিতেন, তাদের এখন ৩৪৪৮ টাকা দিতে হবে। তারা অনেক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, এখানে সরকারের ২০ শতাংশ রেয়াত রয়েছে।

ক্ষুদ্র শিল্পে যাদের বিল আসত ১৬৫৫০ টাকা, তা বেড়ে হবে ১৭৩৬০ টাকা। মাঝারি শিল্পে যাদের মাসে ৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিল হত, তাদের এখন ৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা হবে।

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রবৃদ্ধি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক, ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা, মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তা সব কিছু একেবারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এই মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিইআরসি।

তবে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলছেন, যে ব্যয়ের যুক্তি বিইআরসি দেখিয়েছে, তা অযৌক্তিক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণশুনানিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলাম।

“বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় যেভাবে অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, সেসব প্রতিবিধানের কথা আমরা বলেছিলাম। ৯ হাজার কোটি টাকার উপরে অযৌক্তিক ব্যয় যদি সমন্বয় করা হত, তাহলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হত না।”

গত বছরের জুনের শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দুই মাসের মাথায় বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব প্রস্তাবের ওপর গত ২৮ নভেম্বর শুরু হয় গণশুনানি।

ততে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) পাইকারিতে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল।

তাছাড়া বিতরণকারী বা খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো ও নেসকো দাম বাড়ানোর আবেদন করে । যুক্তি হিসেবে পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন ও সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে।

তবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) পক্ষ থেকে বলা হয়, পাইকারিতে দাম না বাড়লে তাদের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

গত নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি চলাকালে বাইরে বিক্ষেভ।

গণশুনানিতে ক্যাবের উপদেষ্টা বলেছিলেন, “কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন না থাকলেও সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এই কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের উপর।”

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বিদ্যুৎ খাতেও চালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন অধ্যাপক শামসুল।

তিনি বলেছিলেন, “সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির দেওয়া তেলে চলতে পারলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিজেরা পৃথকভাবে তেল আমদানি করে। ফলে সেখানে অনেক বেশি বাড়তি খরচ হয়। এসব খরচ বিদ্যুতের উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়।

“এছাড়া নিজেরা তেল আমদানির নামে বহু রকমের দুর্নীতি হয়। বিপিসির তেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে সেটার সমাধান করা উচিত। বেসরকারিভাবে তেল আমদানির এই ফাঁদ দুর্নীতির একটি উৎস। এই উৎস বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে ঘাটতির প্রকৃত পরিমাণ হিসাব না করে, সেই হিসাব বিবেচনায় নিয়ে যদি ব্যয় বাড়ানো হয়, সেটা জনগণের সঙ্গে অন্যায় করা হবে।”

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, “বিদ্যুতের এই মূল্য বৃদ্ধি সরকারের লুটপাটেরই বর্ধিত প্রকাশ।”

বাম গণতান্ত্রিক জোটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে বেসরকারি ব্যক্তি মালিকদের মুনাফার উদ্দেশ্যে লুণ্ঠনের এক অভয়ারন্য তৈরি হয়েছে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কোন বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা তাদেরকে দিতে হচ্ছে। ফলে এই লুটপাটের দায় জনগণ কেন নেবে?”