জুলাই-এপ্রিল: বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে আরেকটু

বাণিজ্য ঘাটতির মত চলতি হিসাবের ঘাটতিও কমে এসেছে দশ মাসে। তবে ওভারঅল ব্যালেন্স ও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি বড় হতে শুরু করেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2023, 05:17 AM
Updated : 9 June 2023, 05:17 AM

বৈদেশিক ‍মুদ্রা সাশ্রয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানামুখী পদক্ষেপে অর্থবছরের দশ মাসের হিসাবে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ আরও একটু কমে এপ্রিলে ১৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। 

বাণিজ্য ঘাটতির এই পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪৩ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।   

আগের মাস মার্চ পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের নয় মাসের তুলনায় ৪১ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম।

  • জুলাই-এপ্রিল সময়ে দেশে আমদানি হয়েছে ৫ হাজার ৮৭৮ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের দশ মাসে আমদানি ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৮৬৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

  • জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৩০৪ কোটি ডলার আয় হয়েছে, তাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের আলোচিত সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৯৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

  • তাতে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ৫৭৩ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের দশ মাসের তুলনায় ৪৩ দশমিক ১৯ শতাংশ কম।

  • অর্থবছরের দশ মাসে সেবা খাতে ঘাটতি বেড়ে ৩২৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালের এপ্রিল শেষে সেবা খাতে ঘাটতি ছিল ৩১১ কোটি ২০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্য ঘাটতির মত বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়ার গতিও কিছুটা কমেছে। তবে সামগ্রিক লেনদেন (ওভার অল ব্যালান্স) এবং ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতির পরিমাণ বড় হতে শুরু করেছে। 

  • জুলাই-এপ্রিল সময়ে বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে হয়েছে ৩৭৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৪৮ কোটি ডলার। এ হিসাবে ঘাটতি কমেছে ৭৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

  • এপ্রিল শেষে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতি বেড়ে ৮৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৬ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে ঘাটতি ছিল ৫২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

  • চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের দশ মাসের তুলনায় ১১৮ দশমিক ০৭ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ১১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

  • আগের মাস মার্চে এ হিসাবে ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিলে তা আরও ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ বড় হয়েছে।

দুটি সূচকে উন্নতির পরও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বাড়ার বিষয়টিকে অর্থনীতির জন্য নতুন উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। 

এ হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া মানে হচ্ছে বিনিময় হার আরো চাপে পড়বে। টাকার মান আরও কমে গেলে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ বেড়ে যাবে। তাতে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হবে এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে।

ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি স্বল্প মেয়াদী ঋণের প্রবাহ কমে যাবে জানিয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাবে ঋণ ও বিনেয়োগের বেলায়। তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, হয়ত বাংলাদেশ থেকে সময় মত বিনিয়োগ বা মুনাফা ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।” 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই এসেছে ৪২০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ৩০ কোটি ডলার বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩৮৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। 

তবে এই ১০ মাসে কমেছে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ। নতুন বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ থেকে পুরনো বিনিয়োগ তুলে নেওয়া ও মুনাফা ফিরিয়ে নেওয়ার পরিমাণ বাদ দিলে নিট বিনিয়োগের হিসাব পাওয়া যায়।

এপ্রিল শেষে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪৯ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৬৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। 

ফাইন্যান্সিয়াল হিসাবের ঘাটতি পূরণে বিনিময় হারকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সাদিক আহমেদ। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ এক বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার কমে গেল। টাকার মান এক দশকের বেশি সময় ধরে রাখাটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ধীরে ধীরে মান কমানোর সুযোগ দিলে বাজার অনুযায়ী তা এক সময়ে স্থিতিশীল হত। এখনতো টাকার মান ধরে রাখা সম্ভব হল না।” 

তিনি বলেন, “অর্থনীতির ধারা মানতে হবে। টাকার মান আরেকটু কমলে যে মূল্যস্ফীতির চাপ আসবে তা শুল্ক ছাড়, বাজার তদারকিসহ সরকারি উদ্যোগে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এছাড়া অল্প সময়ের জন্য সুদহার বাড়াতে হবে, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হয়।”

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ প্রয়োজনের চেয়ে কমে যাওয়ায় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। রেমিটেন্স প্রবাহ আরেকটু বাড়লে ফাইন্যান্সিয়াল হিসাবে এতটা চাপ আসত না। 

এ হিসাবে ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং টাকার অবস্থানকে স্থিতিশীল করতে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ যে কোনো উপায়ে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নতুন ঋণ সংগ্রহ এখন আগের চেয়ে কিছুটা কঠিন হবে... অনেকেই নতুন ‍ঋণ দিতে চাইবে না। তার চেয়ে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি ঋণ দ্রুত ছাড়ের উদ্যোগ নিতে হবে।

“রেমিটেন্স বাড়ানোর আরো সুযোগ রয়েছে। সরকারকে ব্যাংকিং চ্যানেলে তা আনতে প্রণোদনা বাড়ানো ও একাধিক বিনিময় হার একটিতে আনতে হবে বাজারের উপর ছেড়ে দিয়ে।” 

জুলাই-এপ্রিল ১০ মাসে প্রবাসী আয় হিসেবে রেমিটেন্স এসেছে এক হাজার ৭৭১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের দশ মাসে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।

চাপে থাকা বিনিময় হারকে বাজারের উপর ছেড়ে দিলে তা ১১৪-১১৫ টাকা বা আরেকটু বেশি হলেও এক পর্যায়ে স্থির হবে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। 

তিনি বলেন, “এতে মূল্যস্ফীতির ওপর আরেকটু চাপ এলেও তা হবে সাময়িক। অর্থনীতি নিজেই ভারসাম্যে ফেরার সুযোগ পাবে। নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা না রেখে অর্থনীতিতে আসার সুযোগ দিতে হবে।’’ 

রেকর্ড ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি এবং চলতি হিসাব ভারসাম্যে ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শুরু হয়েছিল চলতি অর্থবছর। 

এরপর নানামুখী উদ্যোগে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসার পাশাপাশি চলতি হিসাবের ঘাটতিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। 

চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা মানে নিয়মিত লেনদেনে কোনো ঋণ করতে হয় না দেশকে। আর ঘাটতি থাকলে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

রিজার্ভ কমে আসা এবং চলতি হিসেবে রেকর্ড ঘাটতির মধ্যে সরকার বাজেট সহায়তাসহ আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী ও দেশের কাছ থেকে অর্থায়ন পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে সরকার। 

এর প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেই পেয়েছে বাংলাদেশ। কিস্তিতে অবশিষ্ট অর্থ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের মধ্যে। 

বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে বুধবার ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী জুন নাগাদ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণের অর্থ পাওয়ার আশায় রয়েছে বাংলাদেশ। 

এসব অর্থ ছাড় হলে চলতি হিসাবের ঘাটতি আরও কমে আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।