“মেগাসিটিতে খাদ্য পণ্যের চেয়ে বিভিন্ন খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্তদের বেশি নাকাল করেছে। গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী এবং ওএমএস চালু থাকায় মূল্যস্ফীতির প্রভাব কম পড়েছে।”
Published : 21 Jan 2023, 04:31 PM
মহামারী আর ইউক্রেইন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতায় গত বছরের রেকর্ড মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, এতে গ্রামের চেয়ে বেশি ভুগেছে শহরের মানুষ। সেইসঙ্গে খাবারের চেয়ে জীবন চালানোর অন্যান্য খাতে মানুষের খরচ বেড়েছে বেশি।
শনিবার ক্যাবের পক্ষ থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবির।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের বরাতে তিনি বলেন, ২০১১ সালের পর ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়। এর প্রভাব সবথেকে বেশি পড়েছে রাজধানী ঢাকায় সাধারণ মানুষের কেনাকাটায়।
ক্যাবের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সাল জুড়ে গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, খাদ্যপণ্যে যা ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ আর খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ। দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের বেলায় এই মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
মাহফুজ কবির বলেন, মেগাসিটিতে খাদ্য পণ্যের চেয়ে বিভিন্ন খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্তদের বেশি নাকাল করেছে। গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী এবং ওএমএস চালু থাকায় মূল্যস্ফীতির প্রভাব কম পড়েছে।
বিদ্যুৎ, সাবান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসামগ্রী, মশার কয়েল, স্প্রে, পোশাক, জুতার মতো খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম বৃদ্ধি, সেইসঙ্গে চাল, আটা, ডাল, বেকারি পণ্য, চিনি, মাছ, ডিম, দেশি মুরগি, ভোজ্য তেল, আমদানিকৃত ফল, চা-কফি, স্থানীয় এবং আমদানিকৃত দুধ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে বাড়তি পরিবহন খরচকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কোভিড পরবর্তী ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা ও মন্দাভাবের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ভেঙে পড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ডলারের বিপরীতে টাকার উচ্চ অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ। এছাড়া মন্দার আশঙ্কায় সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস ও এলসি মার্জিন বাড়ানো এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রবর্তনের মাধ্যমে বিলাসপণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার মতো বিষয়গুলোও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ।
“এসব কারণে আমদানিকৃত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির দাম বেড়েছে; সেইসঙ্গে জ্বালানির উচ্চ মূল্য এবং বিদ্যুতের রেশনিং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, আমদানিকৃত জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও বিপণন ব্যয় বেড়েছে। এসব কারণে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।”
মাহফুজ কবির বলেন, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় শহুরে জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপ ও অসহায়ত্ব দেখেছে। তাই সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
“এছাড়া শহুরে নিম্ন-মধ্য এবং মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।”
ক্যাবের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলগুলোতে ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসের তুলনায় অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ গড় মূল্যস্ফীতি ছিল। সাধারণ মূল্যস্ফীতি অবশ্য ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বাড়তে শুরু করে, যা আবার মে মাসে একটু কমে আসে। পরে জুন থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে।
এরপর জ্বালানি তেলের দামের ব্যাপক দাম বৃদ্ধির পর হঠাৎ করে অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায়। পরবর্তী দুই মাস বৃদ্ধির পর ডিসেম্বরে তা কিছুটা কমে আসে। মৌসুমি সবজির সহজলভ্যতা, আমন ধানের বাম্পার ফলন এবং মাংস ও মাছের দাম কমে এই স্বস্তি ফেরে।
ঢাকায় সাধারণ পরিবারের তুলনায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর গড় মূল্যস্ফীতির চাপ কম ছিল বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি কম ছিল। বছরের শুরু থেকেই খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির একটি সাধারণ প্রবণতা দেখেছেন ভোক্তারা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ্বে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সাধারণ আয়ের মানুষের ওপর। আর নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রভাব কম দেখা গেছে, কারণ তাদের কেনাকাটা খুব মৌলিক, কম দামের এবং সীমিত খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
আবার কিছু পণ্যের দামের মৌসুমী প্রভাবে (ফল এবং সবজি) তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল মূল্যের পণ্যে যেমন- মোটা চাল এবং সস্তা মাছে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
সুপারিশ
মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য ওএমএস স্কিম শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে ক্যাব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এক কোটি পরিবারের খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থানের আওতা বাড়াতে হবে।
“পাশাপাশি মৌলিক জ্বালানি পণ্য, বিশেষ করে ডিজেলের ওপর আবার ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে; কারণ এটি সেচ আর পণ্য পরিবহন খরচের একটি বড় অংশ।”
মাহফুজ কবির বলেন, “গ্যাস পানি বিদ্যুতের দাম আর বাড়ানো যাবে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য লোন বাড়াতে হবে। সৌর সেচ ব্যবহার করতে হবে; কারণ এতে সবচেয়ে কম খরচে এনার্জি পাওয়া যায়।
“গত বছর আমাদের মার্কেট মনিটরিং যথেষ্ট ছিল না। ভোক্তা অধিকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রতিযোগিতা কমিশন, ক্যাবসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে সমন্বয় করে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
ক্যাবের সভাপতি সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “মূল্যবৃদ্ধি হলে রাতারাতি তা কমে যাবে, এই আশা আমরা করতে পারি না। আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের দিকেও তাকাতে হবে। শুধু সহায়তা স্কিম না বাড়িয়ে সরকারকে মানুষের আয় বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। আয় বাড়লে মানুষের উপর চাপ কমবে।”
সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, কোষাধ্যক্ষ হারুন-উর-রশিদসহ অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন-
মূল্যস্ফীতি: শহরের চেয়ে গ্রাম ভুগছে বেশি