Published : 17 Nov 2023, 11:09 PM
বিদেশি ঋণে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে গত ১৫ বছরে দেশে পুঞ্জিভূত ঋণের পরিমাণ বেড়ে তিনগুণ হয়েছে, আর ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে হয়েছে চারগুণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই চাপ এখনও সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও রিজার্ভ বাড়াতে না পারলে মেগা প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ শুরু হলে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর কয়েক বছরের মধ্যে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেড়ে এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি যেখানে ছিল ২১ বিলিয়ন ডলার, গত জুন মাস পর্যন্ত তা বেড়ে ৬২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের কিস্তি বাবদ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা প্রথমবারের মত এক বিলিয়ন ডলারের ঘর পেরিয়ে যায়।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নেওয়া বিদেশি ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ৩৫৬ কোটি ডলার। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৪২১ কোটি ডলারের ঘর ছাড়িয়ে যাবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মেট্রোরেলসহ কয়েকটা মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে, যেখানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এখনই কিছুটা বেকায়দায় আছে সরকার। নানামুখী চাপের মধ্যে রিজার্ভ ইতিমধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলছেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধের যে চাপ আছে, এখনও তা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যায়নি। জাতীয় বাজেটে এখনো অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধের তুলনায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ অনেক কম। তবে পরিস্থিতি বেশিদিন স্বস্তির জায়গায় থাকবে না।
“সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বৈদেশিক ঋণে যে ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করা হয়েছে, তাতে নিকট ভবিষ্যতে সেই ঋণ পরিশোধের একটা চাপ অবশ্যই আসবে। বিদেশি ঋণ ডলারে পরিশোধ করতে হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় একটা চাপ পড়বে।”
সেই চাপ মোকাবিলা করতে রপ্তানি এবং প্রবাসী আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প দেখছেন না এই অর্থনীতিবিদ।
আর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি‘র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলছেন, এ পরিস্থিতিতে তুলনামূলক কম সুদের ঋণের দিকে মনযোগ বাড়াতে হবে বাংলাদেশকে।
“কয়েক বছরের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রবাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে। তাই এখন থেকে সরকারের উচিত হবে আপাতত কয়েক বছর বৈদেশিক ঋণের চাপ কমানোর চেষ্টা হিসেবে কম সুদের এবং দীর্ঘ মেয়াদের ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করা।”
যেভাবে বাড়ছে ঋণের পরিশোধের চাপ
ইআরডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পুঞ্জিভূত স্থিতি ছিল ২০ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৮৫ কোটি ডলার। ওই অর্থবছরে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৫ কোটি ৫৪ লাখ ডলার।
এই সময়ে সরকারের বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে একদিকে ঋণের স্থিতি এবং পরিশোধ দুটোই বাড়ে সমান্তরালভাবে।
বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে ২০১২ সালে। ওই বছর বাংলাদেশ দাতাদের কাছে ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল।
পরের বছরগুলোতে সরকার বিদেশি ঋণে প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন করে। ২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত দশ বছরে প্রায় ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি হয়।
ওই ঋণের বড় একটি অংশ সময়মত ছাড় করাতে না পারায় আটকে আছে। গত জুন পর্যন্ত সময়ে পাইপলাইনে আটকে থাকা ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দাতাদের পুঞ্জিূভূত পাওনা থেকে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৮৩ কোটি ৩৯ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৯১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ২৭৯ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৫৬ কোটি ডলার। এরমধ্যে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ৮৭ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে।
ইআরডির প্রাক্কলন অনুযায়ী, আগামী অর্থবছর থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়ছে। আগামী অর্থবছরে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৪২১ কোটি ডলার এবং ২০২৫ সালে প্রায় ৪৭২ কোটি ডলারের পরিশোধ করতে হতে পারে।
ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দাতা দেশ বা সংস্থা যে অর্থ পাওনা রয়েছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ ঋণ পাওনা বিশ্ব ব্যাংকের। এরপর ২৪ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওনা এডিবির; ১৭ শতাংশ পাওনা রয়েছে জাপানের।
এছাড়া রাশিয়া ৯ শতাংশ, চীন ৮ শতাংশ, ভারত ২ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও আইডিবি ১ শতাংশ অর্থ পাবে।