চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে থাকা শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের কাছে নতুন করে আরও ২৫ কোটি ডলার ধার চাইলেও এবার সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Published : 04 Apr 2022, 10:30 PM
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা ওই ঋণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছি না, কারণ আমাদেরই এখন অনেক চাহিদা রয়েছে।”
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তলানিতে নেমে যাওয়া এর একটি বড় কারণ।
এ বছর কলম্বোকে প্রায় ৬৯০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, অথচ জ্বালানি তেল, খাদ্য, কাগজের মতো নিত্যপণ্য আমদানির মত যথেষ্ট বিদেশি মুদ্রাও সরকারের হাতে নেই। তেল কিনতে না পারায় দেখা দিয়েছে চরম বিদ্যুৎ সংকট। খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ৩০.২ শতাংশে পৌঁছেছে।
এই সংকটের শুরু হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগেই। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে গতবছর শ্রীলঙ্কার বাংলাদেশের শরণাপন্ন হয়। ২০ কোটি ডলার ধার দিয়ে সে সময় বন্ধুপ্রতীম দেশটির পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
‘কারেন্সি সোয়াপ’ ব্যবস্থায় নেওয়া ওই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল তিন মাসের মধ্যে। লাইবর রেটের সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তবে শ্রীলঙ্কা তা দিতে পারেনি। তাদের অনুরোধে ঋণের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সময়েও ডলার ফেরত পাওয়ার আশা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে না।
আগের টাকা ফেরত না দিলেও নতুন করে শ্রীলঙ্কার ২৫ কোটি ডলার ঋণ চাওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি উঠে আসে দেশটির একটি সংবাদমাধ্যম।
গত ২৯ মার্চ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে উদ্ধৃত করে নিউজফার্স্ট জানায়, বাংলাদেশের কাছে আরো ২৫ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে শ্রীলঙ্কা।
বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে কলম্বো গিয়ে ওই সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলেন মোমেন।
তিনি তখন বলেন, “বাংলাদেশ সব সময় শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করতে চায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় আঞ্চলিক দেশগুলোকে সহযোগিতা করতে চান। যখন শ্রীলঙ্কা সমস্যায় পড়েছিল, আমরা ঋণ দিয়েছিলাম। সেটাই ছিল আমাদের প্রথমবারের মত কোনো দেশকে ঋণ দেওয়া। শ্রীলঙ্কা এখনো সমস্যার মধ্যেই আছে। এই কারণে আমরা সেই টাকা ফেরত নেওয়ার সময় বাড়িয়ে দিয়েছি।
“তারা আমাদের কাছে আবারো টাকা চেয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছি। এখন পরিস্থিতি খুব জটিল। এখন অনেক অনিশ্চয়তা। আমরা জানি না এই যুদ্ধ (ইউক্রেইন) শেষে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। বাংলাদেশ আমদানি করা জ্বালানির উপর অনেকটা নির্ভরশীল। এই অবস্থায় আমরা আরেকটি ঋণ দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখছি, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।”
যেসব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম, তারা বিপদে পড়লে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে ধার করে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভে ৪৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে মোট খরচ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে ওই অর্থবছরে মাসিক খরচ হয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের মত।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশ মোট ৪৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। সেই হিসাবে, প্রতি মাসে গড়ে খরচ হয়েছে ৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার করে।
এবার বাংলাদেশ শ্রীলঙ্ককে ঋণ দেবে কি না জানতে চাইলে গত শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আগেরবার খুব দ্রুততার সাথে বৈদেশিক মুদ্রা সহায়তা শ্রীলঙ্কাকে দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখনকার পরিস্থিতিতে বিষয়টি পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষে এই ঋণ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু শ্রীলঙ্কার তো অবস্থা এখন অনেক খারাপ। আমরা এমন জায়গায় তো টাকা দিতে পারি না, যেখান থেকে আমাদের টাকা ফিরে পেতে সমস্যা হতে পারে।… আমরা মনে করছি, এখন অধিক ইনভলভমেন্ট একটু ঝুঁকিপূর্ণ।”
বিশাল অঙ্কের ঋণ, তার সঙ্গে মহামারীর খাঁড়া আর ইউক্রেইন যুদ্ধ একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে সোয়া ২ কোটি মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাকে।
দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কমেছে যে, তা দিয়ে এক মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
এ পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে জনবিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামাল দিতে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। মন্ত্রিসভার সব সদস্য একযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।