বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ফের তিন হাজার ৩০০ কোটি (৩৩ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে। কিন্তু মহাসংকটের সময়ে এই রিজার্ভ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারা।
Published : 30 Apr 2020, 05:51 PM
আড়াই বছর পর গত ১ মার্চ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর তা কমে যায়।
দুই মাসের ব্যবধানে তা ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে আট মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক উদ্বেগজনক দিকে মোড় নিলেও আমদনি ব্যয় কম থাকায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার খানিকটা ‘স্বস্তিদায়ক’ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
তবে বর্তমান এই সংকটের সময়ে ৩৩ বিলিয়ন রিজার্ভ যথেস্ট নয় বলে মনে করছেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আহসান মনসুর বলেন, “এখন আমদানি অনেক কম হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেই আমদানি বেড়ে যাবে। তখন সেই ব্যয় মেটাতে প্রচুর ডলার খরচ করতে হবে; রিজার্ভে টান পড়বে।
“কোভিড-১৯ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করে দিচ্ছে। দিন যতো যাচ্ছে সংকট ততোই বাড়ছে। কঠিন এই পরিস্থিতিতে খাদ্য, ওষুধসহ অন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই পরিস্থিতিতে এই ৩৩ বিলিয়ন রিজার্ভ কিন্তু যথেষ্ট নয়।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার।
“এটা ঠিক যে, এই কঠিন সময়েও আমাদের রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। আমাদের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার আরও বাড়াতে হবে। আমদানি বাড়তে শুরু করলেই রিজার্ভে চাপ পড়বে। কেননা, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সে খুব সহসা আশার আলো দেখতে পাওয়া যাবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৭ সালের ২২ জুন রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। মাস দুয়েকের মধ্যে তা আরও বেড়ে ৩৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ওটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ।
আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। আড়াই বছর পর গত ১ মার্চ সেই রিজার্ভ ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। মাঝের এই আড়াই বছরে রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৫০ থেকে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় সাড়ে ৬ শতাংশের মত কমেছে। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ।
বিজিএমইএর হিসাবে, চলতি এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনে তৈরি পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮৫ শতাংশের মতো কমেছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকলেও মার্চ মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এপ্রিলে পরিস্থিতি আরও করুণ। প্রথম ২৭ দিনে মাত্র ৭৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের এসময়ে এসেছিল প্রায় দ্বিগুণ, ১৪ কোটি ডলার। গত মার্চে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ৫ শতাংশের মত।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
সর্বশেষ গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আকুর বিল (প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার) পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের আকুর বিল পরিশোধ করতে হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।
তার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে থাকবে বলে জানিয়েছেন কাজী ছাইদুর রহমান।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ মজুদ থাকতে হয়।
ডলার বিক্রি করেই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
এদিকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবারও ৩৭ মিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল) ৭৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের কাছেই প্রায় অর্ধেক ৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
চলতি এপ্রিল মাসে বিক্রি করা হয়েছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক কিনেছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত জ্বালানি তেল এবং এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির এলসি খুলতেই (ঋণপত্র) এখন বেশি ডলার ব্যয় হচ্ছে। আর এর সিংহভাগই করছে অগ্রণী ব্যাংক।
অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের হাতে যথেষ্ট ডলার রয়েছে।
জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলা এসব ব্যাংকে এলসি খুললে অগ্রণী ব্যাংকের উপর চাপ কমবে; বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এতো বেশি ডলার বিক্রি করতে হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্রণী ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে টাকা পাচ্ছে সেই নগদ টাকাটা কিন্তু আটকে থাকছে। সেক্ষেত্রে বাজারে তারল্য সরবরাহ কমে যাচ্ছে। যেটা এই সংকটময় মুহূর্তে মোটেই ভালো নয়।
“সোনালী বা ইসলামী ব্যাংকের কাছে থাকা ডলার দিয়ে যদি জ্বালানি তেল ও এলএনজির এলসি খোলা হতো তাহলে কিন্তু এই টাকাটা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আটকে থাকতো না; বাজারে থাকতো।”
এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্টোবাংলাকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা।