ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি সঞ্চালন লাইন মেরামতের মধ্যেই জাতীয় গ্রিডের আরেকটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেওয়ায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণ জনপদের অন্তত ৩২ জেলার মানুষকে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়েছে।
Published : 02 May 2017, 01:31 PM
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সহকারী ম্যানেজার (জনসংযোগ) এ বিএম বদরুদ্দোজা খান জানান, ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইনে মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিভ্রাট দেখা দেয়।
ফলে পিজিসিবির রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল জোনে বিদ্যুৎ সরবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং তাতে করে সেসব এলাকার সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনও থেমে যায়। এরপর এলাকাভেদে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী বিকাল সোয়া ৩টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা দ্রুত সিস্টেম রিস্টোর করার চেষ্টা করছি। এখন অবস্থা অনেকটা ভালো, অধিকাংশ জায়গায় বিদ্যুৎ এসে গেছে। বাকি জায়গাগুলোতেও শিগগিরই চলে আসবে বলে আমরা আশা করছি।”
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২ হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মোট ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে।
পিজিসিবির ওই চার জোনে মোট ৩২টি জেলা রয়েছে, যেখানে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বসবাস।
এর বাইরে ঢাকা জোনের জেলা ফরিদপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার খবর পাঠিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিরা।
বদরুদ্দোজা খান জানান, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ খুঁজতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে পিজিসিবি। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
যেভাবে বিপর্যয়ের শুরু
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এমডি সাজ্জাদুর রহমান জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে সোমবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালীপুরে একটি বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে পড়ে ২৩০ কিলোভোল্টের সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২৩০ কেভি লাইন হাই ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের মধ্যে পড়ে। সারাদেশে পিজিসিবির ৩ হাজার ১৮৫ সার্কিট কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন রয়েছে।
আশুগঞ্জের ওই লাইন মেরামত করার মধ্যেই মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ঘোড়াশাল-ঈশ্বরদী সঞ্চালন লাইন ‘ট্রিপ’ করলে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশের জেলাগুলো বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে বলে পিজিসিবির বদরুদ্দোজা খান জানান।
পিজিসিবির এমডি জানান, জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য দুটি ২৩০ কেভির লাইন আছে। একটি আশুগঞ্জ থেকে সিরাজগঞ্জে, আরেকটি ঘোড়াশাল থেকে ঈশ্বরদীতে।
ঝড়ে আশুগঞ্জ থেকে সিরাজগঞ্জ লাইনের টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঘোড়াশাল থেকে ঈশ্বরদী লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়।
“কিন্তু এ লাইনটি ওভারলোডের কারণে ট্রিপ করে। ফলে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওয়েস্টার্ন গ্রিড আমাদের ইস্টার্ন গ্রিড থেকে আলাদা হয়ে যায়। ফলে ওই এলাকার প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়।”
কোনো কারণে কোনো কেন্দ্র বা সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো সিস্টেমে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কিছু এলাকা বিদ্যুৎহীন রেখে অথবা অন্য কোনো গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এনে ‘লোড’ সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা করা না গেলে অর্থাৎ লোড সমন্বয় না হলে অন্য কেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ বাড়ে।
এভাবে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর নতুন করে কোনো কেন্দ্র বন্ধ হলে সরবরাহে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং একইভাবে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রও বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এর আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সঞ্চালন কেন্দ্রে বিপর্যয় দেখা দিলে ভারতের সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভারতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া।
একই সময় দেশের উৎপাদনে থাকা সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে গেলে, ধস নামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি
এদিকে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ জনপদের জেলাগুলোর বাসিন্দাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে খবর দিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। হাসপাতাল ও জরুরি সেবাকেন্দ্রগুলোকে নির্ভর করতে হয় জেনারেটরের ওপর।
সিরাজগঞ্জ পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলী (বিতরণ) আলমগীর মাহফুজুর রহমান জানান, তার এলাকায় ১১টা ৫৫ মিনিটে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেলা পৌনে ৩টার দিকে বিদ্যুৎ এলেও সরবরাহ কম থাকায় বিকাল ৫টা পর্যন্ত অনেক এলাকায় লোড শেডিং চলছিল।
পিজিসিবি ঝিনাইদহ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী উত্তম কুমার সাধু জানান, পদ্মার পশ্চিম পাশের সবগুলো জেলার মানুষকেই বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়তে হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় পিজিসিবির বটতৈল স্টেশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু তালেব জানান তার এলাকায় বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর ১২টা ৩ মিনিটে আসে। কিন্তু পৌনে ১টার দিকে আবারও চলে যায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা ওই পরিস্থিতি চলে।
একই রকম পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন পাবনা, খুলনা ও যশোরের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
ওজোপাডিকোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, “বরিশালে সাড়ে ১১টার দিকে ট্রিপ করে। এর কিছুক্ষণ পরে ভোলা থেকে ২২-২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাও বন্ধ হয়ে যায়। দেড়টার পর থেকে জাতীয় গ্রিড থেকে পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ায় তা দিয়ে সাবস্টেশনগুলো সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। পরে ধীরে ধীরে সরবরাহ বাড়তে থাকে।”