ব্যাংকিং চ্যানেলে তিন মাস ধরে ডলারের দর স্থির থাকায় আইএমএফ মনে করছে, বিনিময় হার পুরোটা বাজারমুখী হয়নি।
Published : 11 Dec 2024, 04:33 PM
বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে ফের তাগাদা দিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে সবশেষ তৃতীয় কিস্তির অর্থের ব্যবহার ও শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি দেখতে আইএমএফের এই প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করছে।
আন্তর্জাতিক এ ঋণদাতা সংস্থার গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যর প্রতিনিধি দলটি গত ৪ ডিসেম্বর থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করছে। সেই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
গত তিন মাসের বেশি সময় ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ১২০ টাকায় স্থির রয়েছে। অন্যদিকে খোলাবাজারেও ১২২-১২৩ টাকায় লেনদেন হচ্ছে ডলার। ব্যাংকিং চ্যানেলে এ দর ১২০ টাকায় স্থির থাকায় আইএমএফ মনে করছে, বিনিময় হার পুরোটা বাজারমুখী হয়নি।
সেজন্য তৃতীয় কিস্তিতে দেওয়া শর্তে উল্লেখ থাকা ক্রলিং পেগ পদ্ধতির বাস্তবায়ন চেয়েছে আইএমএফ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত তিন মাস ধরেই একটি জায়গায় স্থির আছে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। দর পুরোপুরি বাজারমুখি করতে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ, যাতে ডলারের দর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজারের চাহিদা ও যোগানের সঙ্গে সমন্বয় করে ওঠা-নামা করে।’’
বৈঠকে আইএমএফ এর প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ডলারের বিনিময় হার নিয়ে গত ছয় মাসের একটি গ্রাফ দেখান।
সেখানে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ গত তিন মাস ডলারের বিনিময় হারের রেখায় কোনো ওঠানামা হয়নি।
সে কারণে বিনিময় হার উন্মুক্ত করতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাস্তবায়নের পরে তৃতৃীয় কিস্তি ছাড়ের আগে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর এই শর্ত জুড়ে দিয়েছিল আইএমএফ।
সে অনুযায়ী গত মে মাসে দ্বিতীয় কিস্তির রিভিউ পর্যালোচনা চলাকালে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ক্রলিং পেগ পদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর মুদ্রানীতিতেও ‘ক্রলিং পেগ’ বাস্তবায়ন করার ঘোষণা আসে।
ক্রলিং পেগ হল স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার মান সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। কোনো মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়, যাকে ক্রলিং পেগ মিড রেট (সিপিএমআর) বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারে না, আবার কমতেও পারে না।
গত মে মাসে সর্বপ্রথম সিপিএমআর ঘোষণা দেওয়ার সময় ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ১১৭ টাকা। এরপর গত সেপ্টেম্বর থেকে ১২০ টাকা করা হয়।
তখন থেকে এ দরেই ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার বিনিময় হচ্ছে। অতীতে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ডলারের দর কত হবে তা ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিত।
সেক্ষেত্রে ঘোষিত দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ৫০ পয়সা যোগ-বিয়োগ করে বৈদেশিক মুদ্রা কেনা বেচার সুযোগ দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কোভিড মহামারী থেকে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময় ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করে বসলে আন্তর্জাতিক বাজারের দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে ডলারের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তখন থেকে সরবরাহ সঙ্কটে দাম বেড়ে ডলারের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।
বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে যায়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের দর নির্ধারণ শুরু করেছিল।
এরপর গত জানুয়ারিতে মুদ্রানীতি ঘোষণায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এবিবি ও বাফেদার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এরপারই গত মে মাস থেকে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে আইএমএফ এর পরামর্শে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ চুক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী চতুর্থ কিস্তিতে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ আছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ এসডিআর। চতুর্থ কিস্তি পেলে মোট ৩৫ কোটি ২৩ লাখ এসডিআর (আইএমএফ মুদ্রা) পেয়ে যাবে বাংলাদেশ, যা ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মোট ঋণের ৩৩ শতাংশ।