রাজশাহী উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করার বিপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বলেছেন, “রাকাব ব্যাংক হিসেবে হয়ত ভালো করতে পারেনি, কিন্তু উত্তরাঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।”
Published : 02 May 2024, 09:53 PM
একীভূত বা মার্জ করে ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্তে দ্বিমত না থাকলেও ‘জোর করে একীভূত করা ঠিক হবে না’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
তিনি মনে করেন, এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। যেসব ব্যাংক একীভূত করা হবে তাতে তাদের সম্মতি থাকা বাঞ্ছনীয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টাস ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘কনভারসেশন উইথ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এ কথা বলেন।
দুর্বলকে ভালো ব্যাংকে পরিণত করার আরও পথ আছে মন্তব্য করে সাবেক গভর্নর এও বলেন, ‘‘মার্জার (একীভূতকরণ) একমাত্র পথ নয়।“
বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনায় ব্যাংক সংখ্যা অনেক বেশি এমন কথা বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই। খেলাপি ঋণ, আর্থিক কেলেঙ্কারি বেড়ে যাওয়াসহ সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয়ায় ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
ইতোমধ্যে ব্যাংক একীভূত করার নীতিমালাও জারি করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে পাঁচটিকে অন্য পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
সেই মতে পদ্মা ব্যাংক নিচ্ছে বেসরকারি শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক। অন্যগুলোর মধ্যে বিডিবিএল ও সোনালী ব্যাংকে, সিটি ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবিকে এক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংশ্লিষ্টদের ডেকে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন গভর্নর। এর মধ্যে পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত হতে চুক্তি করেছে তার উপস্থিতিতে। আলোচনায় থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর নাম এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিডিবিএল ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া অনুমোদন হয়েছে।
অবশিষ্ট তিন ব্যাংকের মধ্যে বেসিক ও রাকাব একীভূত না হওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে একীভূত না হতে।
গভর্নরের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘‘দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিণত করার আন্তর্জাতিক পদ্ধতি মার্জার বা একীভূতকরণ। যেসব ব্যাংক মার্জ হবে তাতে তাদের সম্মতি থাকা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। জোর করে তা করা ঠিক হবে না।’’
বিশেষ করে উত্তরের কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে প্রতিষ্ঠা করা রাকাবকে একীভূত করার বিরোধী সাবেক গভর্নর। তিনি বলেন, ‘‘রাকাব ব্যাংক হিসেবে হয়ত ভালো করতে পারেনি, কিন্তু উত্তরাঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উত্তরাঞ্চলের কৃষির কথা বিবেচনা করে রাকাবকে একীভূত না করলেও হয়।’’
‘একমাত্র পথ খেলাপি ঋণ আদায়’
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণার পরও মূল্যস্ফীতি বাগে না আসা নিয়েও কথা প্রতিক্রিয়া জানান ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘‘বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উপায়ে ট্রেজারি বন্ড আকারে টাকা ছাপিয়ে মার্কেটে দিচ্ছে, এ কারণেই মূল্যস্ফীতি কমছে না।
‘‘এগুলো কমানোর একমাত্র পথ হলো খেলাপি ঋণ আদায় করা।’’
গত ডিসেম্বরে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৯ শতাংশ।
সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের ১০ শতাংশ পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে হয়। বড় খেলাপিরা মাত্র দুই শতাংশ দিলেই হয়।
ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণ যার যত বড় হয়ে যায়, সে তত বেশি শক্তিমান হয়ে যায়। একজন কৃষককে ১০ হাজার টাকা খেলাপি ঋণের জন্যে জেলে যেতে হয়। মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকার শিল্প ঋণের খেলাপিকে সালাম দেওয়া হয়, পাশে বসিয়ে সম্মান দেখানো হয়।’’
গভর্নর থাকার সময়ে ২০০৩ সালে তার উপর সুদ মওকুফের চাপ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি সেটা কীভাবে করব! আমার, আপনার মত গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রাখি, কিছু সুদ পাই। কিন্তু যত বেশি খেলাপি তত বেশি শক্তিমান, তত বেশি সুদ মওকুফ পায়। এটা একটি নৈতিক অবক্ষয়, এটা করতে হয় না। দেশের সবাই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। কিন্তু কেউ অনেক বেশি আবার কেউ একেবারেই কম।’’
সাংবাদিকদের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, ‘‘আগের তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অবক্ষয় হয়েছে, সেটার সঙ্গে আমি একমত।’’
পুঁজিবাজার শক্তিশালী হওয়া উচিত ছিল
ব্যাংকগুলোতে স্বল্পমেয়াদি আমানতের পরিমাণ বেশি বলে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিলে সমস্যা হয় জানিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “এজন্য পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার দরকার ছিল। তবে পুঁজিবাজার শক্তিশালী হয়নি।”
ঋণ ও কর খেলাপ এবং অর্থপাচার একই সূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রবাসীরা কষ্ট করে আয় করেন আর সেই অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
‘‘বছরে ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয় দেশ থেকে। যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ থাকে, শরীর ঢাকতে ভালো কাপড় থাকে না। তারা বিদেশে কষ্ট করে দেশে অর্থ পাঠায়। সেই অর্থ পাচার হয়ে যায়।’’
ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে সংলাপটির সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
আরও পড়ুন
একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত ‘এখনই না’, সময় নেবে এনবিএল: চেয়ারম্যান
৪০ বছর পেরিয়ে অন্য ব্যাংকে মিলবে এনবিএল, আলোচনায় ইউসিবির নাম