“অলরেডি বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত। আমার মনে হয়, ব্যয়টা সাশ্রয় করলে ঘাটতি কিছু কমবে। ব্যয়টা করতে হবে যাতে মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়ে।”
Published : 06 Jun 2024, 10:22 PM
প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে যে অংকের ঋণ নিতে হবে, তাতে বহুমুখী সংকট দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের আশঙ্কা, সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণনির্ভরতার যে বার্তা বাজেটে এসেছে, তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিবে, চাপ বাড়াবে বেসরকারি খাতে।
দুর্বল অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলো বড় ঋণের ‘চাপ সামলাতে পারবে না’ দাবি করে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে লাগাম টেনে ঋণনির্ভরতা কমালে সংকটে থাকা অর্থনীতির চাপ কিছুটা কমবে।
নানামুখী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রস্তাব করেছেন, তার ১৭ শতাংশের বেশি তাকে জোগাড় করতে হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।
এবারের বাজেটের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হলে ৩৬ শতাংশের বেশিই জোগাড় করতে হবে ঋণ করে।
সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মত ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন মাহমুদ আলী।
এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে ব্যাংক থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংক তো এমনিতেই তারল্য সংকটে রয়েছে, ব্যাংক কোত্থেকে দেবে? আরেকটি দিক হল- ব্যাংকিং সেক্টরের যে অবস্থা, দুরবাস্থা বলব… মানুষ তো ব্যাংকে টাকাই রাখছে না, আস্থা নেই। ব্যাংক থেকে কি করে টাকা নেবে সরকার?”
তার ভাষায়, নতুন অর্থবছরের জন্যও ‘ঋণ নির্ভর’ একটি বাজেট অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, যা বর্তমান বাস্তবতায় ঠিক হয়নি।
“অলরেডি বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত। আমার মনে হয়, ব্যয়টা সাশ্রয় করলে ঘাটতি কিছু কমবে। ব্যয়টা করতে হবে যাতে মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়ে।”
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে পরিস্থিতি, তাতে বাজেটের আকার ‘ঠিকই আছে’।
তবে বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্য সরকার ধরছে, সেটাকে ঠিক বলতে পারছেন না তিনি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা যখন অর্থায়নের দিকে তাকাই, তখন দেখব সরকার ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা নিচ্ছে ব্যাংক খাত থেকে। অথচ এই খাতটি অনেক দুর্বল একটি খাত। এই খাত থেকে এত টাকা সরকার নিয়ে নিলে ব্যক্তি খাতের চাহিদা মিটবে কী করে?
“ব্যক্তিখাতের ইকোনোমি হচ্ছে ৮৭ শতাংশ। আর সরকারের হচ্ছে ১৩ শতাংশ। সরকারই যদি সব টাকা নিয়ে ফেলে, তাহলে এই ৮৭ শতাংশের ফান্ডিংটা কোথা থেকে হবে?”
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার নাম এখন মূল্যস্ফীতি। ইতোমধ্যে এই হার দুই অংক ছুঁই ছুঁই। এ অবস্থায় সরকার বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যে ধরেছে, তা সংকট আরো বাড়াবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা।
তিনি বলেন, “এই ঋণটা আমরা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিতে যাই, তাহলে সেটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিবে। সুতরাং এই দিকটায় লক্ষ্য রাখার দরকার ছিল।”
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের ধারণা ছিল, বাজেট যেহেতু ছোট, তাই খরচ কিছুটা কমবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে তার প্রতিফলন তিনি দেখেননি।
“দেখলাম ঘাটতি বাজেট ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সেগুলো সরকার খরচ করবে। এদিক থেকে আমি বলব, বাজেট ঠিক হয়নি। আরেকটু বেটার হতে পারত। অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমানো যেত। প্রায়োরিটি প্রজেক্টে খরচ করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কেন ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাখলেন?
“প্রায়োরিটি প্রজেক্ট ছাড়া বাকি সবকিছু বন্ধ রাখেন এখন। আপনি স্কুল করছেন, কিন্তু স্কুলে শিক্ষা উপকরণ নাই। হাসপাতাল করছেন, ডাক্তার নাই, মেশিন নাই। এগুলো কেন করছেন? ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আয়কর সরকার উঠাতে পারবে না। ব্যয় তো আবার ঠিকই করবে।”
ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিলে বেসকরারি খাত ঋণ পাবে না বলেও মনে করেন সালেহউদ্দিন।
“এমনি ব্যাংক খাতের অবস্থা খুবই খারাপ। তারল্য সংকট রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক আবার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করেছে। ক্রেডিট যদি কমে যায়, ব্যবসা যদি না বাড়ে, তাহলে আপনি ট্যাক্স কোথা থেকে আদায় করবেন? করপোরেট ট্যাক্স, ভ্যাট, যাই বলুন, ব্যবসা ভালো না হলে সেগুলো আদায় করা যাবে না।”
ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার না হলে সরকার কর আদায় কোথা থেকে করবে, সে প্রশ্নও রাখেন তিনি।
তবে বাজেটের আকার নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, “বাজেটের আকার রিজনেবল, বাস্তব সম্মত। এখানে বড় প্রশ্ন হল- রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের দিকটা। প্রথমে বলি- ব্যয়ের দিকটায় সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। ১২,০৯৮টি প্রজক্টে এডিপি দিয়েছে, এগুলো অর্থহীন বেশিরভাগ প্রজেক্ট। এগুলো কমিয়ে নিতে হবে।”
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েও আপত্তি আছে সালেহউদ্দিন আহমেদের।
তিনি বলেন, “যেখানে আয়ের উপর সর্বোচ্চ কর আছে ৩০%, এটা অত্যন্ত যুক্তিহীন কাজ। আমার সর্বোচ্চ আয়ের উপর ৩০% ট্যাক্স দেব, আর কালো টাকা নিয়ে ১৫% ট্যাক্স দেব। এটা কী করে হয়?”
আইএমএফ এর চাপের মধ্যেও কৃষি ও জ্বালানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখায় সরকারের প্রশংসা করেন সাবেক গভর্নর।
তিনি বলেন, “আইএমএফ বলছে কৃষি ভর্তুকি কমাও, জ্বালানি ভর্তুকি কমাও- আইএমএফের এ ধরনের পরামর্শ আমলে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাদের পরামর্শ আমলে যদি না নেয়, ভর্তুকি যদি থাকে, যথাযথস্থানে ভর্তুকি দেওয়াটা আমার মনে হয় সমীচীন হবে। সেদিক থেকে বাজেটের এ দিকটা বাস্তবসম্মত।”
নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সেটাও বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন সালেহউদ্দিন।
তিনি বলেন, “এটা সঠিক উদ্যোগ। মূল্যস্ফীতি কমাতে এটা সহায়তা করবে। সাথে সাথে বাজারটা মনিটর করতে হবে।”
পরোক্ষ কর কমিয়ে সরকারকে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোরও পরামর্শ দেন তিনি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, টেলিকম খাতে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি।
“কিছু কিছু জায়গায় আয়কর বাড়নো হয়েছে। যেটা সবসময়ই থাকে। কিন্তু আমি মনে করি, টেলিকম সেক্টরের ওপর করহার বাড়ানো যৌক্তিক না। এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি প্রোডাক্টিভ খাত। এ খাতটি রাজস্বও দিচ্ছে, প্রবৃদ্ধিও দিচ্ছে। তাহলে এই টেলিকম খাতে কর বাড়ানো হল কেন?”
সরকার মুদ্রানীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করলে মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ রাখা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি।
“বছরের শেষ নাগাদ এটি কাছাকাছি যেতে পারে। আমরা রাজস্বের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু বড় ধরনের সংস্কার দেখছি। যেটার প্রয়োজন রয়েছে।”
অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, বাজেটে বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতা আছে, নতুনত্ব খুব বেশি নেই।
“বাজেটের আকার ৫ শতাংশের মত বাড়ানো হয়েছে। সার্বিকভাবে আমরা যদি রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে না পারি, তাহলে আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব না।”
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক বিদিশার মতে, বেশ কিছু খাতে ব্যয় কমানোর সুযোগ ছিল।
“বিদ্যুৎ বা যোগাযোগ ও সড়ক- ভৌত অবকাঠামোর যে খাতগুলো, সে সমস্ত জায়গায় কিছুটা কাটছাঁট করার সুযোগ ছিল। আর পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কাটছাঁটের সুযোগ ছিল। সেটা করে বাজেটের আকার আরও ছোট রেখে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়াটা যদি একটু কম রাখা যেত, তাহলে সেটা মূল্যস্ফীতির জন্য এবং সার্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এবং ব্যাংকের তারল্য, ব্যক্তিখাতের ঋণের প্রবাহকে নিশ্চিত করার জন্য এটা আরও ইতিবাচক হত।”
মধ্যবিত্তদের করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেন অর্থনীতির এই শিক্ষক।
“মধ্যবিত্তদের এক ধরনের আশা ছিল। করের হার বিভিন্ন জায়গায় বাড়ানো হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় করের হার বাড়ানোর দরকার রয়েছে। সেটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা আবার দেখছি, অতি ধনীদের আমরা করে আওতায় চিন্তা করি, সেক্ষেত্রে ওয়েলথ ট্যাক্সে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতিধনীদের জন্য চার কোটি টাকা পর্যন্ত সারচার্জ মওকুফ করা হয়েছে। এই জায়গাটিতে কিছু কাজ করা যেত। অতিধনীদের আরও বেশি করের আওতায় আনা যেত। বরং মধ্যবিত্তদের করমুক্ত আয়সীমা পরিবর্তন করা যেত।
“আমি একটু অবাক হলাম, এবারের বাজেট বক্তৃতায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য খুব বেশি প্রণোদনা লক্ষ্য করিনি। এই জায়গাটায় সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি, গ্রামীণ অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু ওই জায়গাগুলাতে আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। যে জায়গায় কর ছাড় দিলে আমরা আরো বেশি রিটার্ন আনতে পারি, সেই জায়গাটায় কর ছাড় দেওয়াটা যৌক্তিক।”
রাজস্ব আদায় সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হলেও বাজেটে করের আওতা বাড়ানোর জন্য খুব বেশি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মনে করছেন বিদিশা।
তিনি বলেন, “করের হার বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু করের আওতা বাড়ানো হয়নি। করের হার বাড়ানোটা অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তদের ওপরে একটি চাপ তৈরি করে। কারণ যারা কর দিচ্ছে, তাদের ওপর অতিরিক্ত কর হয়। কিন্তু যারা কর দিচ্ছে না, তাদের কীভাবে আমরা করের আওতায় আনব, সে বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা বাজেটে থাকলে সেটা ভালো হত।”
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদের মতে, এবারই প্রথম ‘বিবেচনাপ্রসূত’ বাজেট হয়েছে।
“এবারের বাজেটটি সংকোচনমূলক করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে একই সাথে মূল্যস্ফীতি কমাতে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমানো ও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো তো পরোক্ষ কর। এগুলো জনগণের ওপর এবং দ্রব্যমূল্যের ওপরই গিয়ে পড়বে। উদ্দেশ্য-বিধেয়র সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো কঠিন হবে, তারপরও আশাবাদী থাকতে হবে।
“যদি অর্থনীতিকে সুস্থ করা যায়, সুশাসন ঠিক করা যায়, প্রবৃদ্ধি যদি সক্রিয় থাকে, বিদেশে টাকা পাচার যদি কমানো যায়, রেমিটেন্স যদি বাড়ানো যায়, তাহলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে না। তবে সেটা ‘যদি’র উপরে থাকবে।”
আব্দুল মজিদের ভাষায়, বাজে যতই ‘স্বাস্থ্যবান ও সুষম’ হোক, সবকিছুই নির্ভর করবে বাস্তবায়ন পরিস্থিতির ওপর।
“পরিস্থিতি নির্মাণ করাটাও বাজেট প্রণেতাদের দায়িত্ব। সবদিকে সরকারকে সঠিকভাবে মনোযোগ দিতে হবে।”