বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে সিপিডি।
Published : 16 Mar 2025, 06:30 PM
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসেই বাড়তি শুল্ক বসানোর যে নীতি গ্রহণ করেছে তাতে বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
বরং বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ ‘সীমিত ও স্থিমিত’ হওয়ার শঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন তিনি।
রোববার সকালে ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কার্যালয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট সুপারিশ নিয়ে সংস্থার সংবাদ সম্মেলনে মোস্তাফিজুর রহমান বক্তব্য রাখছিলেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, “বৈশ্বিক যে ‘ট্যারিফ ওয়ার’ শুরু করেছেন তিনি (ট্রাম্প) তার নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ওপর পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার আশঙ্কা আছে এবং সেখানে চাহিদা যেটা আছে সেটার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
“তাহলে আমাদের রপ্তানির যে সুযোগ সে সুযোগ কিন্তু কিছুটা সীমিত এবং স্থিমিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কাজেই এটা কোনভাবেই কাম্য না।”
এর আগেও ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর চীনের তৈরি পোশাকের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি।
সে সময় বাংলাদেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণের তথ্য মেলেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে গিয়েছিল। আবার এই বছর বেড়েছে, বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “সুতরাং এটার ফলে সরাসরি কোনো উপকার আমাদের হবে বলে মনে করি না।”
এর ব্যাখ্যায় এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৯৩ শতাংশ রপ্তানি হয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। চীনের যে তৈরি পোশাকের ওপর ৩৫ শতাংশের মত শুল্ক বসানো হয়েছে, মূলত সেটা কৃত্রিম সুতার পোশাক (মেন মেইড ফাইবার), সুতি নয় (নন-কটন)। আর বাংলাদেশের পুরোটাই হল সুতি কাপড়ের পোশাক।
তিনি বলেন, যে পণ্যে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করেছে সে পণ্যে বাংলাদেশ চীনের প্রতিযোগী নয়। তৈরি পোশাকের মধ্যে অন্তঃপোশাক যে বৈচিত্র সেটাও মাথায় রাখার কথা বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা যেটা বলছেন, এই ধরনের ‘ট্যারিফ ওয়ার’ উনি (ট্রাম্প) শুরু করেছেন, এর ফলে বৈশ্বিক যে প্রবৃদ্ধি তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এবং নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির ওপরও।
“তাদের যে চাহিদা সাধারণ জনগণের, সেটা কমবে এবং এটা মূল্যস্ফীতিও বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্রে। তার ফলে কিন্তু তাদের চাহিদাও কমে যাবে আমদানির জন্য। ফলে আমাদের মত দেশগুলো যারা রপ্তানি করছি, যে চাহিদাটা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সেটার ওপরও কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
করমুক্ত আয়সীমা চার লাখের সুপারিশ
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রে বর্তমান বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে সিপিডি।
বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এ প্রস্তাব আসে বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তরফে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের সুপারিশ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের ওপর ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ হারে কর রয়েছে। গত বাজেটে সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ করা হলেও তা পরে নামিয়ে ২৫ শতাংশেই রাখা হয়। সিপিডি ন্যায্যতার প্রশ্নে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলেছে।
অন্যান্য প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “চ্যালেঞ্জপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বাজেটটি প্রণয়ন করবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব সংগ্রহে স্থবরিতা, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটসহ নানান অর্থনৈতিক সংকট সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব।
“২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট এমন একটি সময়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে যখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্চের মুখোমুখি। এটি মোকাবিলায় দূরদর্শী ও সমন্বিত নীতিগত নেওয়া প্রয়োজন। মুদ্রানীতি স্থিতিশীলতা নীতিনির্ধারকদের অন্যতম কাজ। এটি অর্জনের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থীতিশীল করা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।”
তার ভাষায়, “অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত পৌছাতে পারে। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি উপরের দিকে ছিল। শহর ও গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে ছিল। এ মাসে মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে গ্যাসের দামের যে প্রস্তাব আছে, সেটা যদি অনুমোদিত হয় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে।
“বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতির ধারা বিবেচনায়, বাংলাদেশ ব্যাংক যে বলছে চলতি বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনবে সেটা বাস্তবে অর্জন নাও হতে পারে বলে আমাদের আশংকা।”
‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সূচারুভাবে সম্পন্ন করা মূলনীতি হওয়া উচিত’ তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “সেটা করতে হলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করা ও রাজস্ব ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়গুলো মাথায় রেখেও বাজেট প্রণয়ন করা দরকার।”
সিপিডির বাজেট সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, “৬০টি পণ্যের শুল্ক হার নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে হবে, যাতে বাণিজ্য ভারসাম্য বজায় থাকে। যাতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ধাক্কাটা আমরা সামলে আনতে পারি। রপ্তানি কারকদের সহায়তা করা জন্য অন্য ধরণের সহায়তার কথা চিন্তা করতে হবে।”
বাজেটের সুপারিশে এনবিআরের সংস্কার আনার কথা বলেছে সিপিডি। এসব সংস্কারের মধ্যে রয়েছে আধুনিক রাজস্ব কাঠামো প্রণয়ন, ডিজিটাইজেশন, সামঞ্জস্যপূর্ণ কর নীতি তৈরি করা, ঝামেলামুক্তভাবে কর দেওয়ার ব্যবস্থা করা।