রাশিয়াকে অর্থ দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ; পরিশোধের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা আছে প্রায় ৮১ কোটি ডলার।
Published : 07 Oct 2024, 09:08 AM
আলোচিত বিদ্যুৎ প্রকল্প রূপপুরের ঋণ ও সুদ পরিশোধ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে জটিলতা বিকল্পভাবে সুরাহার পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ; পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বকেয়া অর্থ এতদিন সরাসরি পাঠাতে না পেরে এখন চীনের মাধ্যমে সেই উপায় খোঁজা হচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিপুল ঋণের সুদের অর্থ পাঠানোর চেষ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের তরফে ঋণের আসল পরিশোধের সময় বাড়ানোর চেষ্টা চলে। তবে রাশিয়া এ প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে সুদের অর্থ পরিশোধে তাগাদা দেয়।
এ নিয়ে উভয় পক্ষে টানাপোড়নের মধ্যে চলমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজে জটিলতা এড়াতে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সুদের অর্থ পাঠাতে বিশেষ বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া সময় বাড়ানোর আগ্রহ না দেখিয়ে বরং সুদের অর্থ চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বাংলাদেশও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের চেষ্টা করলেও কোনো ‘সুরক্ষিত’ মাধ্যম না পেয়ে এখন রাশিয়ার দেখানো পথেই চেষ্টা করছে।
এ নিয়ে জটিলতা ও টানাপোড়েনের মাঝে চীনে অ্যাকাউন্ট খুলে অর্থ পাঠানোর পরবর্তী উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যোগ করেন এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল এক কর্মকর্তা।
কেননা দেশের একমাত্র এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তত থাকলেও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিতে সরাসরি অর্থ পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না।
ইউক্রেইনে সামরিক আগ্রাসনের পর রাশিয়ার ওপর অর্থ পাঠানোর মাধ্যম সুইফট ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে শুরু থেকেই এ নিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ।
সরকারের পালাবদলে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে রাশিয়া গত অগাস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ হিসাবে রাখা সুদের অর্থ চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে তাগাদা দেয়। এতদিন বাংলাদেশ এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও এখন চীনের মাধ্যমেই তা পাঠানোর উপায় খোঁজা শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অ্যাকাউন্টে থাকা জমা অর্থ রাশিয়াতে পাঠাতে বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে বিভিন্নভাবে। এর আগে ইন্ডিয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করা হয়েছে।
“এখন চায়নার মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে। চায়নাতে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে এ ব্যাপারে কার্যত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগেও ছিল, এখন এটাকে জোরদার করার কথা বলা হয়েছে।”
পাবনার রূপপুরে ২০১৬ সালে হাতে নেওয়া এ প্রকল্পের সুদ পরিশোধ করতে না পারায় বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছিল। বকেয়ার পুরো অর্থই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আলাদা করে একটি বিশেষ হিসাবে রাখা হয়েছে।
আসল পরিশোধে আরও দুই বছর সময় চাওয়া হলেও সুদের অর্থ দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে আগেই সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছে।
এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের ব্যয়ের পুরো অর্থ ঋণ হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া। বর্তমানে প্রতিবছর দুই কিস্তিতে ১১ কোটি ডলার সুদ পরিশোধের কথা রয়েছে। তবে ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে প্রতিবছর ছয় মাস পরপর দুই কিস্তিতে মোট ৩৮ কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে দিতে হবে ১১ কোটি ডলারের সুদ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সুদ ও আসলের পরিমাণও হেরফের হতে পারে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে সুদের কিস্তি সময়মত পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার সেই অর্থ জমা করে রেখেছে আলাদা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এসক্রো নামের বিশেষ অ্যাকাউন্টে তা রাখা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা বলেন, “রাশিয়া যে পরিমাণ টাকা আমাদের থেকে পাবে, রুবলে যে পরিমাণ অর্থ পাবে সেটা আমরা আলাদা করে রেখেছি এসক্রো অ্যাকাউন্টে।”
তার ভাষ্য, এসক্রো অ্যাকাউন্ট হল ওই হিসাবের ওপর কারো কোনো স্বত্ব থাকে না। যখন রাশিয়াতে স্থানান্তর হয়ে যাবে তখন পুরো অর্থ চলে যাবে।
সুদের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারার বিষয়টি সুস্পষ্ট করে তিনি বলেন, “এটা ট্রান্সফারের জন্য কোনো সিকিউর ট্রাঞ্জেকশন মোড পাওয়া যাচ্ছে না। কীভাবে এ অর্থ ওখানে ট্রান্সফার করা যাবে। যেহেতু ওদের (রাশিয়া) অ্যাগেইন্সটে সুইফটের স্যাংশন আছে। ইউএস এর স্যাংশন থাকার কারণে সুইফটের মাধ্যমে ট্রান্সফার করা যাচ্ছে না।”
বকেয়ার পরিমাণ কত জানতে চাইলে ‘বলা খুবই মুশকিল’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা খুবই গোপনীয় বিষয়।”
এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা কত?
বাংলাদেশ ব্যাংকের রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ বাবদ বিশেষ অ্যাকাউন্টে ৮০ কোটি ৯ লাখ ডলার জমা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এ নিয়ে মন্তব্য করতে না চাইলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ পরিমাণ অর্থ জমা থাকার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেও একই ধরনের ভাষ্য আসে।
তাদের মতে রাশিয়া সময় বাড়ানোর আগ্রহ না দেখিয়ে বরং সুদের অর্থ চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকদিন ধরেই এসক্রো অ্যাকাউন্টেই সুদ পরিশোধের জন্য ডলার জমা করে আসছিল।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ৬৩ কোটি ডলার জমা হলেও বৃহস্পতিবার অব্ধি এই অ্যাকাউন্টে এক বিলিয়ন ডলারের তিন-চতুর্থাংশের বেশি জমা পড়েছে।
গত ২৫ অগাস্ট অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকেও অর্থ পাঠানোর বিষয়টি সামনে আনেন ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দার মন্টিটস্কি।
বৈঠকে থাকা কর্মকর্তারা বলেন, রাশিয়ার ঋণ পরিশোধের কিস্তি শুরু ও কোন মুদ্রায় পরিশোধ হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। দেশটি সুদ হিসেবে জমা হওয়া অর্থ দ্রুত নিয়ে যেতে চায়।
আসল পরিশোধ কখন
রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে, যে প্রকল্প ২০১৬ সালে নেওয়া হয়েছিল রাশিয়ার সহযোগিতায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুই ইউনিটে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
পাবনার রূপপুরে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, যার ৯০ শতাংশই রাশিয়ার ঋণ হিসেবে পাচ্ছে বাংলাদেশ।
দেশটির এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি হয় ২০১৬ সালে। এর আওতায় ২০১৭ সালে ঋণের অর্থ আসা শুরু হয় এবং এর সুদও পরিশোধ করা করেছে বাংলাদেশ।
রাশিয়া ৪ শতাংশ হারে সুদে ১০ বছরের রেয়াতকালসহ ২০ বছর মেয়াদে পরিশোধের শর্তে এ ঋণ দিচ্ছে।
আগামী ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে রাশিয়ার ঋণের ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষে আসল পরিশোধ শুরু করার কথা। তারা বাংলাদেশের অনুরোধ রাখলে ২০২৯ সালের ১৫ মার্চ থেকে ঋণের আসল পরিশোধের নতুন সময়সীমা ঠিক হত। তবে সময় বাড়ানোর প্রস্তাবে এখনও সাড়ে দেয়নি দেশটি।
রূপপুরে দেশের প্রথম পরমাণু এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ান ফেডারেশনের কোম্পানি অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর চুক্তি হয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের।
প্রকল্পটি ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও এখনও দ্বিতীয় ইউনিটে পারমাণবিক চুল্লিপাত্র স্থাপনের কাজ চলছে।
পুরনো খবর
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ডামি ফুয়েল লোডিং
চালু হচ্ছে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের তৃতীয় সঞ্চালন লাইন
রূপপুরের দ্বিতীয় চুল্লিপাত্রের কাজ উদ্বোধন বুধবার
দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে জায়গা খুঁজছি: প্রধানমন্ত্রী