কাপাসগোলা স্কুল: প্রধান শিক্ষকের আচরণ ‘শিক্ষকসুলভ নয়’, বলছে তদন্ত কমিটি

প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সিটি করপোরেশন গঠিত তিন সদস্যের কমিটি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2023, 10:02 AM
Updated : 9 Feb 2023, 10:02 AM

চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা ‘যৌন হয়রানির’ অভিযোগের ‘প্রাথমিক সত্যতা’ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

তাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রীদের সাথে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদন আলাউদ্দিনের আচরণ ‘শিক্ষকসুলভ’ ছিল না।

সিটি করপোশেন গঠিত তদন্ত কমিটি গত সোমবার প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহারের কাছে তাদের প্রবিদেন জমা দেয়।

সেখানে বলা হয়েছে, কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে আলাউদ্দিন ফেইসবুকের ম্যাসেঞ্জারে তার ছাত্রীদের সাথে ‘চ্যাট’ করার কথা স্বীকার করে মৌখিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন।

আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে কমিটি। তবে এই কমিটি তাদের তদন্তে কোনো ভিকটিম বা চাক্ষুস সাক্ষীর সাক্ষ্য পায়নি।

কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনে ১ জানুয়ারি আন্দোলনে নামে বর্তমান, সাবেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ওইদিন প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তাকে ‘অবরুদ্ধ’ করে বিক্ষোভ দেখায় তারা।

ছাত্রীদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন ক্লাস রুম থেকে ছাত্রীদের নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে ‘গায়ে হাত দেওয়া’সহ তাদের বিভিন্নভাবে ‘যৌন নিপীড়ন’ করেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, তাকে ‘বদলি’ করার জন্য বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রীদের ‘ইন্ধন’ যোগাচ্ছে।

এরপর তাৎক্ষণিকোবে আলাউদ্দিনক বদলি করে দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিল সিটি করপোরেশন। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে প্রধান করে গত ২ জানুয়ারি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

যা যা এসেছে অনুসন্ধানে

অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি দুই দফা বিদ্যালয়ে যায়। গত ৫ ও ৯ জানুয়ারি বিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রী এবং অফিস সহায়কদের সাথে কথা বলে। সবশেষ ১২ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের সাথে কথা বলেন কমিটির সদস্যরা।

জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন কিছু বিষয় তুলে ধরেছে।

সেখানে বলা হয়েছে, “প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পুরোপুরি স্বাক্ষ্য প্রমাণাদি না থাকলেও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ ছাত্রীদের সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করার বিষয়ে তার স্বীকারোক্তি তা প্রমাণ করে। এছাড়া ছাত্রীদের সাথে তার আচরণ যে শিক্ষকসুলভ নয়, তা ছাত্রীদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।”

তদন্ত কমিটি বলেছে, “তদন্তকালে সরাসরি কোন ভিকটিম এর স্বাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ছাত্রী বা অভিভাবক বা সহকর্মী শিক্ষিকাদের কেউই শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে এমনকি মেয়র বরাবর কোনো যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেননি। তবে বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রীদের সাথে জিজ্ঞাসাবাদে তার চরিত্রগত সমস্যা আছে মর্মে কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে।”

স্কুলের বিশেষ কোনো ছাত্রীকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দিয়ে অন্য ছাত্রীদের উপর বিরুপ মনোভাব পোষণ এবং সেই সাথে বিদ্যালয়ে ওই বিশেষ ছাত্রীর জন্মদিন উদযাপন করা প্রধান শিক্ষক হিসেবে ‘পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে না’ বলেও মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সেখানে বলা হয়, প্রধান শিক্ষক কোনো কোনো ছাত্রীকে নিজ কার্যালয়ে একা দেখা করতে বলতেন, সে কথাও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এসেছে।

আচরণ ‘অস্বস্তিকর’: বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ

তদন্ত কমিটি প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে এর কারণ ব্যাখ্যায় বলেছে, “যেহেতু তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে এবং অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এমপিওভুক্ত একজন স্থায়ী কর্মচারী সেহেতু তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।”

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- “প্রধান শিক্ষকের হাতে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির বিষয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষিকারা জানান, এ বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে তারা কিছু অবলোকন না করলেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছাত্রীরা হেডস্যার দেখা করার জন্য বলেছে মর্মে শ্রেণি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেত, যা সাধারণ শিক্ষক শিক্ষিকাদের অপছন্দ ছিল।

“তাছাড়াও মহিলা শিক্ষিকাদের তিনি (প্রধান শিক্ষক) যৌন হয়রানি বা কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করতেন কিনা, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাদের সাথে এ ধরনের কোন আচরণ করেননি মর্মে তারা কমিটিকে জানান। তবে কোনো মহিলা শিক্ষক কখনও একা প্রধান শিক্ষকের রুমে যেতেন না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কারণ প্রধান শিক্ষকের চাহনি তাদের কাছে অস্বস্তিকর ছিল।”

প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ‘উগ্র মেজাজ’ দেখাতেন এবং ‘খারাপ আচরণ’ করতেন বলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অফিস সহায়করা তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ করেছেন।

তবে গত ১ জানুয়ারি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তা সমসাময়িক কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, “মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নতুন নয়। পূর্বের বিভিন্ন অভিযোগ এবং বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই সময়ের মধ্যে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ও আন্দোলন সৃষ্টি করা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, আন্দোলনকারীগণ পরিকল্পিতভাবেই উল্লেখিত তারিখে উপস্থিত ছিলেন।”

প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন এবং তদন্ত কমিটির কাছে তার লিখিত জবাব জমা দেন।

ছাত্রীদের বার্তা পাঠানো ও ফোন করার অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক দাবি করেন, তার ফেইসবুক আইডি হ্যাকড হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি থানায় কোনো জিডি করেননি।

জিজ্ঞাসাবাদের শেষ পর্যায়ে তিনি ছাত্রীদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করার বিষয় স্বীকার করে মৌখিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলতে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে ফোন করলে তিনি ধরেননি। এসএমএস করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। 

পুরনো খবর

Also Read: যৌন নিপীড়ন: চট্টগ্রামের সেই প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত

Also Read: ‘যৌন হয়রানির’ অভিযোগে প্রধান শিক্ষককে ‘অবরুদ্ধ’ করে বিক্ষোভ

Also Read: যৌন নিপীড়ন: চট্টগ্রামের সেই প্রধান শিক্ষককে সরানো হল

Also Read: যৌন নিপীড়ন: চট্টগ্রামের সেই স্কুলে মেয়র