“বাচ্চাটির শরীর থেকে হয়ত মানুষের গন্ধ পাচ্ছে হাতির পাল। তাই শাবকটিকে তারা সহজে গ্রহণ করতে চাইছে না,” বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী।
Published : 19 Oct 2023, 04:55 PM
পাহাড় থেকে খাদে পড়ে যাওয়া ১৫ থেকে ২০ দিন বয়সী একটি হাতির বাচ্চাকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তুললেও সেটিকে তার পালে ফিরিয়ে দিতে পারছে না বন বিভাগ। কারণ, পালের অন্য হাতিরা শাবকটিকে গ্রহণ করছে না।
বন কর্মকর্তাদের ধারণা, ‘মানুষের সংস্পর্শে আসায়, বাচ্চাটিকে নিতে চাইছে না হাতির দল।’
উদ্ধারের পর হাতির বাচ্চাটির জ্বর ছিল। অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন প্রয়োগের পর সেটি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠে। এরপর তাকে পালের কাছে দিয়ে আসা হয় দুই দফা। কিন্তু দুইবারই তাকে ‘ফিরিয়ে দেয়’ বড়রা।
এ অবস্থায় শাবকটিকে কক্সবাজার জেলায় চকরিয়ায় ডুলহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে পাঠানোর কথা ভাবছে বন বিভাগ। তবে তার আগে আরো একবার তাকে পালে ফেরানোর ‘শেষ চেষ্টা’ করবেন কর্মীরা।
চারদিন আগে চট্টগ্রামের বাঁশখালী সরল ইউনিয়নের পাহাড়ি পাইরাং বনে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যায় শাবকটি। নিচে কাদা পানিতে আটকে ছিল সেটি।
স্থানীয়রা জানায়, পড়ে যাওয়ার পর শাবকটিকে ঘিরে হাতির পাল ওই পাহাড়ে অনেক সময় ধরে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু উদ্ধার করতে না পেরে ফিরে যায় তারা। পরে খবর পেয়ে বন বিভাগের কর্মীরা মঙ্গলবার সেটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়।
জলদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শাবকটি এখন কিছুটা সুস্থ। গত দুদিন এটিকে আমরা পালের সঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা শাবকটিকে নেয়নি।
“আপাতত আমাদের তত্ত্বাবধানে রেখে খাবার ও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। পালে না ফিরলে এটিকে সাফারি পার্কে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
শাবকটিকে এখন পাইরাং বনের কাছে লোকালয়ে বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা বেশ স্নেহ দিয়ে রাখছে প্রাণীটিকে। তার সঙ্গে ছবিও তুলতে দেখা গেছে অনেককে।
প্রতিদিন হাতিটিকে ৮ থেকে ১০ লিটার দুধ খাওয়াতে হচ্ছে বলে জানান জলদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ।
চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল রাতে হাতির পাল ওই এলাকায় আছে জানতে পেরে আমাদের লোকজন শাবকটিকে পালের সঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করে। পালের কাছাকাছি জায়গায় সেটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সকালে গিয়ে দেখা যায় সেটি পালের সঙ্গে যায়নি।”
তিনি বলেন, “কয়েকদিন মানুষের সংস্পর্শে থাকায় সম্ভবত হাতির পাল শাবকটিকে আর দলে নিতে চাইছে না।”
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাতি খুব সংবেদনশীল প্রাণী। বাচ্চা হাতিটি পালে ফিরতে না পারার কারণ মানুষ। শত শত মানুষ প্রতিদিন বাচ্চা হাতিটি দেখতে জড়ো হচ্ছে। কেউ স্পর্শ করছে, কেউ খাবার দিতে চাইছে।
“বাচ্চাটির শরীর থেকে হয়ত মানুষের গন্ধ পাচ্ছে হাতির পাল। তাই শাবকটিকে তারা সহজে গ্রহণ করতে চাইছে না।”
পাহাড়েই প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মানো হাতিটিকে প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে ব্যবস্থাপনা করে বাঁচিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হবে বলেও মনে করছেন এই বন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “এই ধরনের হাতি প্রতিদিন প্রচুর খাবার খায়। পাল এটিকে ফিরিয়ে না নিলে লোকালয়ে এভাবে রাখা যাবে না। আমরা আরো দুয়েকবার চেষ্টা করব। সম্ভব না হলে সাফারি পার্কে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।”
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বনে এশীয় প্রজাতির হাতি আছে। বিভিন্ন সময় খাবারের কাছে হাতির পাল লোকালয়ের কাছে চলে আসে।
অধ্যাপকের ভিন্ন ব্যাখ্যা
তবে শাবকটিকে পালের ফিরিয়ে না নেওয়ার বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমীন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাতি খুবই গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণী। বাচ্চা তারা ছেড়ে যাবে না। যে পালটি ওই এলাকায় ঘোরাফেরা করছে বাচ্চাটি সেই দলেরই সদস্য কি না, নাকি সেখানে আরো কোনো দল আছে সেটাও জানতে হবে।”
অন্য একটি সম্ভাবনাও থাকতে পারে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, “বুদ্ধিমান প্রাণী হাতির মধ্যে অনেক যুক্তি কাজ করে। বাচ্চাটি অসুস্থ। তারা হয়ত চায়, যেহেতু মানুষ চিকিৎসা শুরু করেছে, তারাই একে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলুক। যখন তারা বুঝতে পারবে বাচ্চাটি পুরোপুরি সুস্থ, তখন হয়ত তারা সেটিকে পালে ফিরিয়ে নেবে।”
তার ধারণা, হাতির পালটি দু-চারদিনের মধ্যে আবারও সেখানে আসবে। তখন বাচ্চাটিকে সেখানে না পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে আশেপাশের লোকালয়ে তাণ্ডবও চালাতে পারে।
বাচ্চাটিকে পুরোপুরি সুস্থ না করে সেটিকে সেখান থেকে সাফারি পার্কে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না বলেও মনে করেন অধ্যাপক আল-আমীন। তিনি বলেন, “আরেকটু স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে ও চিকিৎসা দিয়ে সেটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা উচিত। আশেপাশে লোকজন যাতে সেটির সংস্পর্শে বেশি না আসে, তাও নিশ্চিত করা দরকার।”