প্রদীপের সম্পদ ‘ঘুষ-দুর্নীতির’: আদালত

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, ‘অবৈধ’ সম্পদ বৈধ দেখাতে সেগুলো স্ত্রীকে হস্তান্তর করেছিলেন প্রদীপ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2022, 05:39 PM
Updated : 27 July 2022, 05:39 PM

মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তোলার অভিযোগ আগেই উঠেছিল টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে। এবার দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগেও দোষী সাব্যস্ত হলেন তিনি এবং তার স্ত্রী।

জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন এবং মানি লন্ডারিংয়ের (অর্থ হস্তান্তর) অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় তাদের দুজনকেই সাজা দিয়েছে চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত।

বিচারক মুন্‌সী আব্দুল মজিদ বুধবার তার রায়ে বলেছেন, একজন ‘স্বল্প বেতনের’ সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এত সম্পদ বৈধভাবে অর্জনের কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি আসামি প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণ।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারি পদে থেকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ মাধ্যমে প্রদীপ ওই সম্পদের মালিক হন প্রদীপ। আর সেসব সম্পদ বৈধ করতে স্ত্রীর নামে হস্তান্তর করে বিভিন্ন ব্যবসা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।

বিচারক তার রায়ে তিনটি আইনের চারটি ধারায় প্রদীপ কুমার দাশকে মোট ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ৪ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো মোট ২ বছর ৮ মাসের সাজা দিয়েছেন।

আর তার স্ত্রী চুমকির মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড, ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার টাকা ও অনাদায়ে আরো মোট ২ বছর ৯ মাসের সাজা হয়েছে।

দুদকের পিপি মাহমুদুল হক মাহমুদ বলেন, “সকল ধারার শাস্তি একসাথে কার্যকর হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের অনুকূলে মামলায় উল্লেখিত সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছে আদালত।”

৬ তলা বাড়ি, ৫ পুকুর লিজ

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার থাকাকালে ২০০৪ সালে পাথরঘাটায় এক বিধবা নারীর জমি দখলের অভিযোগে তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে চাকরিতে ফিরলেও নানা ঘটনায় বিতর্কের জন্ম দেন বার বার।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই ক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া এলাকায় তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওই ঘটনায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এলে তাকে কারাগারে যেতে হয়।

তখন তার নানা অপকর্ম বেরিয়ে আসতে শুরু করলে প্রদীপের সম্পদের খোঁজে নামে দুদক। ২০২০ সালের ২৩ অগাস্ট দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন মামলা করেন প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ২৮ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়ে।

মামলায় বলা হয়, প্রদীপ ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ মাধ্যমে অর্জিত অর্থ গোপন করার জন্য চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় ওই ছয়তলা বাড়ি করেন তার শ্বশুরের নামে। পরে তার শ্বশুর অজিত কুমার কারণ ওই বাড়ি তার মেয়ে চুমকিকে দান করেছেন বলে দেখানো হয়।

আয়কর রিটার্নে চুমকি বোয়ালখালী উপজেলায় ১০ বছরের জন্য লিজ নেওয়া পাঁচটি পুকুরে মাছের ব্যবসার যে আয় দেখিয়েছেন, তা স্বামী প্রদীপ দাশের ‘জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জনের পর স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে দেখানো ভুয়া ব্যবসা’ বলে মামলায় অভিযোগ করে দুদক।

চুমকির সম্পদের তালিকায় আরও আছে নগরীর ষোলশহরের জমিতে সেমিপাকা ঘর, ৪৫ ভরি সোনার গয়না, একটি করে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস এবং কক্সবাজারে একটি ফ্ল্যাট।

বুধবারের রায়ে এর সবই রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

‘ঘুষ-দুর্নীতির সম্পদ বৈধ করার চেষ্টা’

দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রদীপ একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে হস্তান্তর, রূপান্তর ও ভোগ দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, এটা প্রমাণিত হয়েছে।

“এই রায় একটা নজির হয়ে থাকবে। কেউ যদি ভবিষ্যতে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করে তাহলে এই সাজা একটা নজির হয়ে থাকবে তাদের জন্য।”

মাহমুদুল হক বলেন, “প্রদীপের স্ত্রী একজন গৃহবধু। স্ত্রীকে মৎস্য চাষী প্রমাণের চেষ্টায় পুকুর লিজ এবং কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবেও দেখিয়েছেন প্রদীপ। দুজন সাফাই সাক্ষী দিলেও এর পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।

“অন্যের কাছে অর্থ হস্তান্তর (লন্ডারিং), মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সুষ্পষ্ট অপরাধ। পরষ্পর যোগসাজোশে তারা এই অপরাধ করেছে সম্পদকে বৈধ করতে।”

এ অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় প্রদীপ ও চুমকি কারণকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে চার কোটি টাকা করে জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও ২ বছরের সাজা দেয়া হয় প্রদীপ ও চুমকিকে।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্তের দাবি, দুদক যেসব অভিযোগ মামলায় এনেছে তা তারা ‘প্রমাণ করতে পারেনি’।

“এই রায়ে আমরা সক্ষুব্ধ। পুরো রায় পাবার পর আমরা উচ্চ আদালতে আবেদন করব।”

নগরীর পাথরঘাটায় ‘লহ্মীকুঞ্জ’ নামের ছয়তলা যে বাড়িটি চুমকি কারণ বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল বলে দাবি করেছেন এলাকায় সেটি পরিচিত ওসি প্রদীপের বাড়ি হিসেবে।

রায় ঘোষণার পর চুমকির আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লহ্মীকুঞ্জ ভবনটি মেয়েকে দেওয়ার মত সামর্থ্যবান ছিলেন অজিত কুমার কারণ। প্রদীপের শ্বশুর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাদের হার্ডওয়ারের ব্যবসা আছে।

“অজিত কারণের দুই ছেলেও ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক। শুধু চুমকিকে নয়, বড় মেয়েকেও অজিত কারণ ভবন দিয়েছেন। এগুলো তার ব্যবসায় অর্জিত বৈধ সম্পদ।”

অজিত কারণ ও তার দুই ছেলের ট্যাক্স ফাইলেও দুদক অবৈধ কিছু পায়নি বলে দাবি করেন আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগপত্রের ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন। আর ৫ জনের সাক্ষ্য নেননি। মামলার বাদী এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) একই ব্যক্তি দুদক কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন।

“আইও জেরায় বলেছেন, অভিযোগপত্রে উল্লেখিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বাইরে আর কোনো সম্পদ তারা অনুসন্ধানে পাননি। প্রদীপ ও চুমকির ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে এসব সম্পদের উল্লেখ আগে থেকেই ছিল।”

আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত বলেন, “দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগকারী কক্সবাজারের সেলিম এলাহী নামের এক ব্যক্তি। তার অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক তদন্ত শুরু করেছিল।

“কিন্তু মামলার ৩ নম্বর সাক্ষী ওই ব্যক্তিকে আদালতে আনতেই পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। কাজেই অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর ও মানি লন্ডারিং এর কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।”

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি সিনহা হত্যা মামলার রায়ে প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদণ্ড দেয় কক্সবাজার জেলা আদালত।

ওই মামলায় র‌্যাবের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত।

কক্সবাজার যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে থাকাকালেও নানা অভিযোগ ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে। নিজের সৎ বোনের জমি দখল, আইনজীবীকে মারধর এবং একটি বেসরকারি তেল শোধনাগারের লরি আটকে ও চালককে গ্রেপ্তার করে হয়রানির কথাও ছিল সেসব অভিযোগের মধ্যে।