বরাবরই আলোচনায় ওসি প্রদীপ

যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে সহিংস আন্দোলন দমনে চট্টগ্রামে যে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আলোচনায় ছিলেন, তাদের একজন প্রদীপ কুমার দাশ পরে কক্সবাজারে গিয়ে জলদস্যু দমনেও প্রশংসিত হয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2020, 05:33 PM
Updated : 8 August 2020, 05:56 PM

কক্সবাজারের যে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকাকালে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ খান হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই থানায় এসেও ইয়াবা প্রতিরোধে ভূমিকার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ পদক লাভ করেছেন তিনি।

এসব প্রশংসা-পদকের পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযোগে একাধিকবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পাশাপাশি বিভাগীয় মামলায় পড়েছেন প্রদীপ। তবে প্রতিবারই সে সব থেকে মুক্ত হয়ে ‘ভালো জায়গায়’ পদায়ন পেয়েছেন তিনি।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময়ের চাকরি জীবনে বেশিরভাগ সময় ঘুরে ফিরে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) ও কক্সবাজার জেলা পুলিশে চাকরি করেছেন।

মাঝে ২০১৫ সালে সিলেট রেঞ্জে বদলি হলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ফিরে আসেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশে। পরের বছরই তিন চলে যান কক্সবাজারের মহেশখালীতে।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে থাকাকালে জায়গা দখল, আইনজীবীকে মারধরসহ নানা কর্মকাণ্ডের জন্য বিতর্কিত হয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ।

২০০৪ সালে সিএমপির কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) থাকাকালে পাথরঘাটা এলাকায় জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন প্রদীপ। এরপর সিএমপি থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জে সংযুক্ত হন তিনি। চট্টগ্রাম রেঞ্জ থেকে তাকে পদায়ন করা হয় কক্সবাজার জেলায়।

সে সময় কক্সবাজার সদর থানায়ও একটি জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে প্রদীপের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওই বিভাগীয় মামলার কারণে তার পদোন্নতিতে জটিলতা হয়। ২০০৯ সালের শেষ দিকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১০ সালে প্রদীপের পদায়ন হয় সিএমপিতে। ২০১১ সালে দায়িত্ব পান সিএমপির পতেঙ্গা থানার ওসির।

২০১৩ সালে পাঁচলাইশ থানার ওসি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়কে ঘিরে জামায়াত-শিবিরের নাশকতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ।

তবে এই সময়ই হত্যা মামলার এক আসামির আইনজীবীকে আটক করে সমালোচনায় পড়েন তিনি।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ

প্রদীপসহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে অপহরণ মামলা করেন ওই আইনজীবী।

পরে পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় সে মামলা প্রত্যাহার করে নেন ওই আইনজীবী। হয়রানির শিকার আইনজীবীর নাম মো. নুরুল আলম।

সাত বছর পর আইনজীবী নুরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার ওসি প্রদীপ দাশের নেতৃত্বে তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে নির্যাতন করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।

“২০১৩ সালে আরিফ নামে আমার এক মক্কেলের রিমান্ড আবেদন করেছিল পুলিশ। আমি সেটির বিরোধিতা করেছিলাম। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে পকেটে আমার কার্ড পেয়েছিল।”

এরপর তাকে ধরে নেওয়া হয় জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। সম্ভবত ২৩ জানুয়ারি তারিখ ছিল, আমি আদালত থেকে বাসায় ফেরার পথে সিনেমা প্যালেস এলাকা থেকে সাদা পোশাকের পাঁচলাইশ থানা পুলিশের একটি টিম আমাকে তুলে নিয়ে যায়। সারা রাত নির্যাতন করে তারা আমাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।

“মামলা থেকে বাঁচতে তারা আমার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকাও আদায় করে। নির্যাতনের কারণে আমার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এই ঘটনায় আমি ওসি প্রদীপসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে অপহরণ মামলা দায়ের করেছিলাম।”

আইনজীবী নুরুল আলম বলেন, ওই মামলায় আদালত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে কোনো আইনজীবী পুলিশের পক্ষে এ মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আইনজীবী নেতাদের সমঝোতা বৈঠক হয়।

“সেখানে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি মামলা প্রত্যাহার করে নিই এবং আমাকে ক্ষতিপূরণের টাকাও দিয়েছিল।”

পরে পাঁচলাইশ থেকে ওসি প্রদীপ আসেন চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ইমেগ্রেশন পুলিশে এবং সেখান থেকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসির দায়িত্ব পান।

এই সময় বোনের জায়গা দখল করে পুনরায় সমালোচনার মুখে পড়েন প্রদীপ।

প্রদীপের ভাগ্নে সুমন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রদীপ তার মায়ের সৎ ভাই। নগরীর মুরাদপুর এলাকায় তার মায়ের সূত্রে পাওয়া ৩২ শতাংশ জায়গা অর্পিত সম্পত্তি আইনে চলে যায়।

“আমার মামা প্রদীপকে বলেছিলেন জায়গাগুলো উদ্ধার করে দিলে তাকে ছয় গণ্ডা জায়গা দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি উদ্ধার করে না দিয়ে তাকে জায়গা রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে।”

এক পর্যায়ে প্রদীপ নিজে ২৪ শতাংশ এবং অন্য এক ব্যক্তির মাধ্যমে আরও ৬ শতাংশ জমি দখল করেন বলে অভিযোগ সুমনের।

সুমন অভিযোগ করেন, জায়গা আত্মসাতের জন্য প্রদীপ এক নারীকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করিয়েছেন। এই মামলায় তাকে ১৬ দিন কারাবাস করতে হয়েছে এবং এখনও তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।

এদিকে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ওসি থাকাকালে একটি রিফাইনারির তেল আটক করে বরখাস্ত হয়েছিলেন প্রদীপ।

২০১৫ সালের ৪ অগাস্ট সন্ধ্যায় বেসরকারি তেল শোধনাগার সুপার রিফাইনারি থেকে মিরসরাই যাওয়ার পথে নগরীর বায়েজিদ থানার টেক্সটাইল গেইট এলাকায় সাড়ে নয় হাজার লিটার কেরোসিনসহ একটি লরি আটক করে পুলিশ। ওই লরির চালককে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর সুপার রিফাইনারির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে বায়েজিদ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করে পুলিশ।

মামলা হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগারগুলো থেকে তেল সরবরাহ বন্ধের হুমকি দেয় ‘ট্যাংক-লরি চালক-মালিক সংগ্রাম পরিষদ’।

পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে হয়রানির অভিযোগ করেন সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদ।

ওই অভিযোগের পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলমগীরকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্ত শেষে কমিটি বায়েজিদ থানার ওসি প্রদীপ দাশ ও মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।

এছাড়া ‘সঠিকভাবে তদারকি না করায়’ চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার, উত্তর জোনের উপ-কমিশনার, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও পাঁচলাইশ জোনের তৎকালীন সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।

ওই সুপারিশের ভিত্তিতে কৈফিয়ত তলব করলে পুলিশ কমিশনারসহ চার কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত জবাবও দেন।

এই দফায়ও ঝামেলা মুক্ত হওয়ার পর পুলিশের সিলেট রেঞ্জে বদলি হন পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশ। কিছু দিনের মধ্যে আবার চট্টগ্রামে ফিরে ২০১৬ সালে ফের যান কক্সবাজারে,  মহেশখালীর ওসি হয়ে।

মহেশখালীতে জলদস্যু দমনে তার ভূমিকা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সেখান থেকে ২০১৮ সালের মে মাসে তাকে টেকনাফ থানায় বদলি করা হয়।

টেকনাফে ইয়াবা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম লাভ করেন প্রদীপ কুমার দাশ।

টেকনাফ থানায় ইয়াবা কারবারিদের প্রতিরোধে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় আলোচিত ও সমালোচিত ছিলেন ওসি প্রদীপ। বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশের প্রধান এলাকা মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এই থানায় গত দুই বছর তার দায়িত্ব পালনকালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সিআইপি হাজী সাইফুল করিম এবং ‘রোহিঙ্গা ডাকাত’ নূর আলমও রয়েছেন।

সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহাড়ছড়া এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ।

এ ঘটনার পর বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফের ওসি প্রদীপ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ সাত পুলিশ সদস্য। ওই দিনই এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রদীপ, লিয়াকতসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাত দিনের রিমান্ডে পায় র‌্যাব। গত শুক্রবার এই পুলিশ সদস্যদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।