সিনহা হত্যা: প্রদীপ-লিয়াকতসহ ৩ পুলিশ র‌্যাবের রিমান্ডে

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার মামলায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সাত দিনের জন্য র‌্যাব হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।

চট্টগ্রাম ব্যুরোকক্সবাজার প্রতিনিধি ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2020, 02:39 PM
Updated : 7 August 2020, 08:16 AM

কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মো. হেলাল উদ্দিন বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাবের দশ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে সাত দিন মঞ্জুর করেন।

প্রদীপ ও লিয়াকতের সঙ্গে রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে এসআই দুলাল রক্ষিতকে। এ মামলায় আত্মসমর্পণ করা বাকি চার আসামি কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং এএসআই লিটন মিয়াকে দুই দিন জেলগেইটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন বিচারক।

মামলার বাকি দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা এখনও পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছে আদালত।

টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের দায়ের করা এই হত্যা মামলায় লিয়াকতকে ১ নম্বর এবং প্রদীপকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে।

শারমিন বুধবার সকালে টেকনাফের বিচারিক হাকিম আদালতে মোট ৯ জনকে আসামি করে ওই মামলা করার পর বিকালে টেকনাফ থানা থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়। পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ ২০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয় দুদিন আগেই।

জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ বুধবার হত্যা মামলাটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলার তদন্তভার দেন র‌্যাবকে।

বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় টেকনাফ থানায় মামলাটি নথিভুক্ত করা হয় বলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বিএম মাসুদ হোসেন জানান।

বৃহস্পতিবার দুপুরে খবর আসে, পরিদর্শক প্রদীপকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে চট্টগ্রামের পুলিশ। এরপর তাকে নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কয়েকটি গাড়ি। 

চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রামের দামপাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে এসেছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। তাকে এখন পুলিশ হেফাজতে কক্সবাজারে নেওয়া হচ্ছে। তিনি যেহেতু মামলার আসমি, তিনি সেখানে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন।”

চট্টগ্রাম থেকে পরিদর্শক প্রদীপকে নিয়ে পুলিশ বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে কক্সবাজারের বিচারিক হাকিম আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছায়। কক্সবাজারে পুলিশ হেফাজতে থাকা পরিদর্শক লিয়াকতসহ বাকি ছয়জনকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তার আগেই।

এ সময় পুরো আদালত এলাকায় নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা। সাংবাদিকদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতা আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করেন। 

মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে বিচারক হেলাল উদ্দিন তা নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

কিন্তু তাদের কারাগারে নেওয়ার আগেই আদালতে হাজির হয় এ মামলার তদন্তভার পাওয়া সংস্থা র‌্যাবের একটি দল।

সিনহা হত্যা মামলায় ওই সাত আসামিকে দশ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে।

শুনানি শেষে বিচারক তিনজনকে রিমান্ডে পাঠিয়ে বাকি চারজনকে কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। পাশাপাশি পলাতক দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন তিনি।

র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আশিক বিল্লাহ রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আসামিদের কারাগার থেকে কক্সবাজারে র‌্যাব-১৫ কার্যালয়ে নিয়ে যাব এবং সেখানে রেখেই জিজ্ঞাসাবাদ করব, ঢাকায় আনার প্রয়োজন নেই।”

ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে ‘বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যার’ যেসব অভিযোগ এসেছে, সেসব বিষয় র‌্যাব দেখবে কি না জানতে চাইলে আশিক বিল্লাহ বলেন, “যে হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব র‌্যাব পেয়েছে, সেটাই দেখা হবে।”

র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক সহকারী পুলিশ সুপার জামিউল হক এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে পরিবারের সদস্যরা ডাকতেন আদনান নামে। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

কী ঘটেছিল

দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা মো. রাশেদ খান ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন।

ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। এই ঘটনায় পুলিশ মামলাও করে।

তবে পুলিশের এই ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এদিকে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে বুধবারই কক্সবাজারের আদালতে মামলা করেন তার বোন শারমিন।

এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, ওসি প্রদীপের ফোনে পাওয়া নির্দেশে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই লিয়াকত আলি গুলি করেছিলেন সিনহাকে।

আদালতে মামলা করার পর সাংবাদিকদের সামনে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস

এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ‘ইচ্ছাকৃত নরহত্যা’, ২০১ ধারায় আলামত নষ্ট ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি এবং ৩৪ ধারায় পরস্পর ‘সাধারণ অভিপ্রায়ে’ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে।  এর মধ্যে ৩০২ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে (২১) মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়।

সিনহা নিহতের ঘটনায় জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের সমিতি রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)।

একই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এরপর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, এই ঘটনায় দায়ী হিসেবে যে বা যারা চিহ্নিত হবে, তারাই শাস্তি পাবে। এর দায় বাহিনীর উপর পড়বে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মঙ্গলবার সিনহার মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ

আলোচিত-সমালোচিত-পুরস্কারপ্রাপ্ত

যার নির্দেশে সিনহাকে গুলি করার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়, সেই পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে।

২০০৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার থাকাকালে পাথরঘাটায় এক বিধবা নারীর জমি দখলের অভিযোগে তিনি বরখাস্ত হন।

এরপর চট্টগ্রাম রেঞ্জে সংযুক্ত হয়ে তিনি কাজ শুরু করেন কক্সবাজার জেলা পুলিশে। পরে পদোন্নতি পেয়ে ২০১০-১১ সালে পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পান।

২০১৩-১৪ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় জামায়াত-শিবিরের নাশকতা প্রতিরোধে ‘গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’ রেখে আলোচনায় আসেন প্রদীপ।

কিন্তু কিছুদিন পর নিজের আত্মীয়র জায়গা দখলের ঘটনায় আবারও তিনি বিতর্কে জড়ান। এরপর পাঁচলাইশ থেকে সরিয়ে তাকে বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি করা হয়।

২০১৫ সালে সুপার রিফাইনারি নামে একটি তেল শোধনাগারের নয় হাজার লিটার তেল আটক করে ফের আলোচনার জন্ম দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। ওই ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

পরে সিলেট রেঞ্জে বদলি হন প্রদীপ। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বদলি হয়ে তিনি সিএমপির ডিবিতে যোগ দেন।

ওই বছরই পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনায় আবু নসুর গুন্নু নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পরিদর্শক প্রদীপের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।

এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে প্রদীপ দাশকে বদলি করা হয় কক্সবাজারে। ২০১৭ সালে উখিয়া থানার ওসির দায়িত্ব পান তিনি। পরে সেখান থেকে বদলি করা হয় মহেশখালী থানায়।

সেখানে জলদস্যু দমনে ভূমিকার জন্য প্রশংসিত হন প্রদীপ। মহেশখালী থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবরে তাকে টেকনাফ থানার ওসি করে পাঠানো হয়।

টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে শতাধিক মৃত্যুর ঘটনায় আলোচিত-সমালোচিত প্রদীপ কুমার দাশকে ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ সম্মাননা বিপিএম পদকে ভূষিত করা হয়।