আহত মুহিব উল্লাহর দাবি, সেদিন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে আরএসও এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে।
Published : 21 Jan 2023, 08:58 AM
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখায় গোলাগুলিতে আহত এক আরএসও সদস্যের দাবি, ২০১৮ সাল থেকে টানা তিন বছর মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকায় তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
তাদের সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) লক্ষ্য ‘আরকানের আজাদী’। নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে বলেও দাবি করেন আরএসও সদস্য মুহিব উল্লাহ।
বুধবার তুমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখায় কোনারপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘আধিপত্য বিস্তারকে’ কেন্দ্র করে দুই সংগঠন আরএসও এবং আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) মধ্যে গোলাগুলিতে একজন নিহত ও একজন আহত হন বলে সেদিন স্থানীয় প্রশাসন ও রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছিল।
সেদিন নিহত হন হামিদ উল্লাহ (২৭)। আর আহত হন মুহিব উল্লাহ (২৩)। আহত মুহিব উল্লাহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুক্রবার রাতে সেখানেই তার সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়।
স্থানীয় প্রশাসন ও রোহিঙ্গা নেতার বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে আরএসও এবং আরসা’র মধ্যে গোলাগুলির খবর এলেও আহত মুহিব উল্লাহর দাবি, সেদিন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে আরএসও এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে।
বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মুসলমান রোহিঙ্গাদের দুই সংগঠন আরসা ও আরএসও নানা সময়েই দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। দমন-পীড়নের শিকার হয়ে ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি দিয়ে শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছে। এখন নতুন করে ওই সীমান্তে সংঘর্ষ চলছে।
শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘আরসা-আরএসও’র গোলাগুলি, নিহত ১
তুমব্রু সীমান্তে গোলাগুলির পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন
তুমব্রু সীমান্তে আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
মুহিব উল্লাহ বলেন, “আমি আরএসও করি। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সীমান্তে ওই পাড়ে মিয়ানমার আর্মির সাথে গোলাগুলিতে আমার গায়ে গুলি লাগে।”
একটি গুলি মুহিব উল্লাহর বুকের পাশ দিয়ে দেহ চিরে বেরিয়ে গেছে। আরেকটা হাতে লেগেছে।
মঙ্গলবার গোলাগুলির পর বিকালে হামিদ উল্লাহ ও তাকে সঙ্গীরা তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে বলে জানান তিনি।
প্রথমে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের এনএসএফ হাসপাতালে নেয় মুহিব উল্লাহকে। সেখান থেকে তিনি বোন জামাই মো. শাকেরকে ফোন দেন। পরে তাকে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে।
মুহিব উল্লাহ জানান, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই তিনি আরএসওতে যুক্ত।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন শুরু হলে মা, বাবা, বোন, বোনের পরিবার ও এক ভাইসহ বাংলাদেশে আসে মুহিব উল্লাহ। তাদের পরিবার টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা শালবন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকে। এর মধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। আর কিছু রোহিঙ্গা তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার ক্যাম্পটিতেও আশ্রয় নেন।
মুহিব উল্লাহর বাবার নাম দিলদার আহমেদ। বাংলাদেশে আসার আগে তারা মিয়ানমারের মংডু জেলায় সাকিপ্রাং গ্রামে থাকতেন। সেখানে স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি মুহিব উল্লাহ।
মুহিব উল্লাহরা পাঁচ ভাই এক বোন। ২০১৭ সালে তাদের পরিবার বাংলাদেশে আসার আগেই তার ৩ ভাই মিয়ানমার থেকে নৌকায় চড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া চলে যান বলে জানান তিনি।
মুহিব উল্লাহ জানান, পরিবারের সদস্যরা আশ্রয় শিবিরে থাকলেও ২০১৮ সালে ঘুমধুম থেকে তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে আবার মিয়ানমারে চলে যান তিনি।
মুহিব উল্লাহ বলেন, “২০১৮ থেকে তিন বছর সীমান্তের ওপারে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমি একে-৪৭, একে-১৬ রাইফেল, রিভলবার চালাতে পারি। ওখানে বড় বড় পাহাড়ে আমাদের প্রশিক্ষণ হয়। মিয়ানমারের আর্মি সেখানে পৌঁছাতে পারে না।”
তাদের গ্রুপে ৮৫ জন আছে জানালেও দলনেতার পরিচয় জানাতে পারেননি মুহিব। তার দাবি, গ্রুপের সদস্যরা একে অন্যের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য জানায় না।
মুহিব উল্লাহ বলেন, “মঙ্গলবার বিকেলে (মুহিবের দাবি গোলাগুলির ঘটনা মঙ্গলবার বিকেলে হয়েছে) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি দলের সাথে আমাদের গোলাগুলি হয়।
তবে নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও রোমেন শর্মা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মঙ্গলবার ঘুমধুম সীমান্তে আন্তর্জাতিক সীমানার শূন্যরেখায় আরসা ও আরএসওর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
মুহিব উল্লাহর দাবির বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইউএনও বলেন, “সীমান্তের বিষয় বিজিবির আওতাভুক্ত।”
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছুদিন পরপর আরএসও এবং আরসার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ নিয়ে আমরা এলাকাবাসী আতঙ্কে আছি।”
রোহিঙ্গাদের দুই সংগঠন আরএসও ও আরসার মধ্যে সংঘাতের কারণ জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে থাকা দুই পক্ষের অনুসারীরা বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
মঙ্গলবার গোলাগুলির পর স্থানীয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শতশত বসতঘর ভস্মীভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
মুহিব উল্লাহ বলেন, “ওরা (মিয়ানমার আর্মি) আমাদের নির্যাতন করেছে (২০১৭ সাল ও তার আগে), মিয়ানমারের লোকজন আমাদের বাঙালি বলে গালি দেয়। আসলে আমরা রোহিঙ্গা। আমাদের ঘরবাড়িতে হামলা করেছে, আগুন দিয়েছে। আমরা আরাকানের আজাদী চাই।”
মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপগুলোই বিভিন্ন সময়ে সরকারি বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে সংঘাতের ইন্ধন দেয়। সেই কারণেই নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চলে।
সুস্থ হয়ে আবার সীমান্ত পার হয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে যুক্ত হতে চান মুহিব উল্লাহ। তিনি বলেন, “আমরা চাই আরাকানের আজাদী। আরাকান হবে স্বাধীন এলাকা। মুক্ত মংডুর সাকিপ্রাং গ্রামে ফিরব আমরা।”