“এ সরকার মুক্তিযোদ্ধা অনেককেই অনেককিছু দিয়েছে। আমরা কোনো স্বীকৃতি পাইনি। তাই আর এখন আমাদের বাড়ির অবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলতেই ইচ্ছে হয় না।”
Published : 17 Apr 2024, 01:32 AM
বোয়ালখালী উপজেলার সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম জ্যৈষ্ঠপুরা। গ্রামটির একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে নদী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ গ্রামটিই হয়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী এবং সাধারণ মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাটির দ্বিতল একটি বাড়ি। যেটি স্থানীয়দের কাছে ‘সেন বাড়ি’ নামে পরিচিত। বাড়িটি ঘিরে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা ইতিহাস। বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করতেন নিজেদের ট্রানজিট পয়েন্ট ও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে।
যুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন। পরবর্তীতে তিনি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জ্যৈষ্ঠপুরা সেন বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতেন। সেখান থেকে কেউ যেতেন প্রশিক্ষণের জন্য আবার কেউ যেতেন যুদ্ধে। আমি নিজেও প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগে বাড়িটিতে গিয়েছিলাম।”
বাড়িটির প্রতিবেশী নিপুল কুমার সেন যুদ্ধের সময় ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। তিনিও জানালেন, যুদ্ধকালীন সময়ে ওই বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল।
সে সময়ে স্মৃতি মনে করে নিপুল বলেন, “এ গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু তরুণ এসেছিলেন। বাড়ির অদূরে মাধব স্কুলে (বর্তমানে মাধব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) উঠতি বয়েসী তরুণদের তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। সেখানে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে এ বাড়িতে ছিলেন। পরে তারা ভারতে যেতেন প্রশিক্ষণ নিতে।”
বাড়িটি পাহাড় ও নদীবেষ্টিত হওয়ায় পাকিস্তানী সৈন্যদের তাণ্ডবের আঁচ সেখানে লাগেনি। তাই বাড়িটিকে নিরাপদ মনে করতেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে কথা বলেন বাড়িটির সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ ছবি সেন। অশীতিপর এই নারীর স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে গেছে যুদ্ধের সময়কার অনেক ঘটনা। তারপরও হাতড়ে বেড়ান।
তিনি জানালেন, যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর এক লোকের সাথে ২০/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রথম ওই বাড়িতে এসেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা যার সঙ্গে এসেছিলেন তার নাম ছিল আবুল হোসেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন স্থানীয়দের কাছে আবুল হোসেন কমান্ডার নামে পরিচিত।
“তারা যখন প্রথম এখানে আসে, এক সপ্তাহ-দশ দিন আমি আর আমার জা তাদের রান্না করে খাইয়েছিলাম। পরে আস্তে আস্তে লোকজন বাড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রাম থেকে সাধারণ লোকজনও আসা শুরু করে। পরে তারা নিজেরাই নিজেদের খাবার রান্না করত। আমাদের চারটি পুকুর ভরা মাছ, চাল... সেগুলোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারাও খাবার নিয়ে আসত, সেগুলো নিজেরা রান্না করে খেতেন।”
ছবি সেন জানান, তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় দুই ছেলেকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ছোট ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকতেন। সাথে ছিলেন তার জা ও স্কুল শিক্ষিকা ননদ।
“মুক্তিযোদ্ধারা যখন সংখ্যায় বাড়তে শুরু করে তখন আমরা বাড়ির লোকজন দুই তলার মূল ঘরটি তাদের জন্য ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণের ছোট আরেকটি কক্ষে গিয়ে সবাই থাকা শুরু করি। এ বাড়িতে সবার যাতায়াত। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে একদল আসত, একদল যেত। অস্ত্রশস্ত্র এখানে এনে সাজিয়ে রাখা হতো। বাড়ির বিভিন্ন দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাহারা রাখতেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনও এখানে এসেছিল।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের বাড়ি নিয়ে ছবি সেনের গর্বের সঙ্গে কিছু অভিমানও জড়িয়ে আছে।
আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “যুদ্ধের পর কেউ বাড়িটির খোঁজও নেয়নি। একবার আওয়ামী লীগের মোসলেম উদ্দিন (চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রায়ত সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য) এসেছিলেন। তিনি খবরাখবর নিয়েছেন। তারপর থেকে লোকজন এসে খোঁজ খবর নিয়েছে, কিন্তু আমরাতো কোনো স্বীকৃতি পাইনি।
“এ সরকারতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। এ সরকার মুক্তিযোদ্ধা অনেককেই অনেক কিছু দিয়েছে। আমরা কোনো স্বীকৃতি পাইনি। তাই আর এখন যুদ্ধে আমাদের বাড়ির অবস্থা নিয়ে কোনো কথা বলতেই ইচ্ছে হয় না।”
ছবি সেনের ছেলে শিবাশীষ সেন শঙ্খু জানালেন, স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক একবার বাড়িতে এসে একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও এসেছিলেন।
এরপর ২০১৮ সালে তৎকালীন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিনও এসেছিলেন। তখন তিনি সংসদ সদস্য হননি। তিনি এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলন করেছিলেন।
২০২২ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যালের প্রসিকিউটর ও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এসেছিলেন সেন বাড়িতে। ওই সময় সেখানে বাড়ির পূর্বপুরুষের ছবি দিয়ে একটি মুর্যাল তৈরি করা হয়েছিল।
শিবাশীষ বলেন, “আমার মা চান প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের বাড়ির বিষয়টি জানাতে। সেজন্য আমরা অনুমতি চেয়েছিলাম। তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান সেটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু করোনামহামারী চলে আসায় সেটি আর এগোয়নি।
“আমরা চাই প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে যুদ্ধকালীন সময়ের সে কথা তাকে জানাব।”