উচ্চতা কত হবে? রেল-সিডিএ দ্বন্দ্বে আটকে চট্টগ্রামের দুই ওভারপাস

সড়কের কাজ শেষ, ওভারপাসের পিয়ার এবং বেশিরভাগ গার্ডারও বসানো শেষ। কিন্তু রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার স্থাপন আর হচ্ছে না।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2022, 08:09 PM
Updated : 2 Sept 2022, 08:09 PM

রেল লাইনের ওপর কত উচ্চতা রাখতে হবে তা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং রেলওয়ের মধ্যে টানাপড়েনে বন্দরনগরীর দুটি ওভারপাসের নির্মাণ কাজে আটকে আছে প্রায় দুই বছর ধরে।

বিতর্কের অবসানে সরকারের এ দুই সংস্থার মধ্যে চিঠি চালচালি, কমিটি গঠন, সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা- সবই হয়েছে; কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।

সবশেষ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে সিডিএ। আর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে মন্ত্রণালয়ে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে নগরীকে যুক্ত করা বায়েজিদ লিংক রোড এবং পতেঙ্গা-সাগরিকা হয়ে টোল রোড ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগকারী আউটার রিং রোড প্রকল্পে ওভারপাস দুটির বেশির ভাগ কাজই হয়ে গেছে।

ওভারপাসের পিয়ার এবং বেশিরভাগ গার্ডারও বসানো হয়ে গেছে। বাকি শুধু রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার স্থাপন। ওই অবস্থায় রেলওয়ের আপত্তিতে আটকে আছে কাজ।

লিংক রোড যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে মিশেছে, (ফৌজদারহাট বিআইটিআইডির মোড়) সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চার লেইনের ওভারপাসটি অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

পাশেই ৬ মিটারের কাছাকাছি উচ্চতার একটি দুই লেইনের ওভারপাস দিয়ে যানবাহন চলছে। দুই লেইনের লিংক রোড নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে ১৯৯৭ সালে এই ওভারপাসটি নির্মাণ করা হয়।

সড়ক প্রকল্পটি আর না এগোনোয় দীর্ঘদিন তা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। পরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছাড়াই সড়কটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

তখন থেকে দুই লেইনের ওভারপাসটি দিয়েই চার লেইনের এ সড়কে যান চলাচল করতে থাকে।

বিপত্তি উচ্চতা নিয়ে

২০১৬ সালের জুনে ১৭২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার এই লিংক রোড প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে দুই লেইন করার কথা থাকলেও ২০১৬ সালের অক্টোবরে মোট ৩২০ কোটি টাকায় তা চার লেইনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আউটার রিং রোড এবং ওই বছরের শেষ দিকে ঢাকা ট্রাংক (ডিটি) রোড (ফৌজদারহাট)- নগরীর বায়েজিদ অংশকে সংযোগকারী লিংক রোডের কাজ শুরু হয়।

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, ২০১৬ সালে রেললাইনের ওপর ওভারপাসের জন্য রেলওয়ে নির্ধারিত উচ্চতা ছিল ৬ দশমিক ৫ মিটার। ২০১৮ সালে সেটা বাড়িয়ে করা হয় ৭ দশমিক ৫ মিটার।

“আমরা ৭ দশমিক ৫ মিটার রেখে লিংক রোড এবং আউটার রিং রোডের ফিডার রোড-৩ এর দুটি ওভারপাসেরই কাজ শুরু করি। সবশেষ ২০২০ সালে রেলওয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ মিটার করতে বলে। তখন প্রায় সব পিয়ারের কাজ শেষ। এখন রেললাইনের অংশ ছাড়া বাকি অংশে গার্ডার বসানোও শেষ।”

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একজন কর্মকর্তা জানান, মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ডবল ডেকার কন্টেইনারবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য ওভারপাসের উচ্চতা ৮ দশমিক ৫ মিটারে উন্নীত করার কথা বলা হয়। সে কারণে ওভারপাস দুটির ক্ষেত্রে তারা আপত্তি জানিয়েছেন।

সুফল আটকে ওভারপাসে

বায়েজিদ লিংক রোডের ওভারপাস অংশে উত্তর-দক্ষিণমুখী কাছাকাছি দূরত্বে তিনটি রেল লাইন।

এর একটি লাইন ধরে নগরীর হালিশহরে চট্টগ্রাম ‍গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) থেকে কন্টেইনার ও ভোগ্যপণ্যবাহী ট্রেন ঢাকা-সিলেটসহ অন্যান্য গন্তব্যে চলাচল করে। অন্য ‍দুটি লাইন ধরে চলে যাত্রীবাহী ট্রেন।

ওভারপাসের মাঝামাঝি অংশে চারটি পিয়ারের ওপর গার্ডার বসানো হয়নি। বাকি অংশে গার্ডার বসানোর কাজ শেষ। দুই লেইনের ছয় মিটারের কম উচ্চতার ওভারপাসটির নিচ দিয়ে নিয়মিত সবরকম ট্রেন চলছে।

লিংক রোডে পুরো সড়কে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হলেও পুরনো দুই লেইনের ওভারপাসে এসে উভয়মুখী গাড়ির গতি কমাতে হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলেও একই দৃশ্য দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম আউটার রিং রোডের দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট সংলগ্ন অংশে গিয়ে দেখা যায়, ফিডার রোড-৩ (সাগরিকা জহুর আহম্মদ চৌধুরী স্টেডিয়াম সংলগ্ন অংশে) এর ওভারপাসটিরও একই দশা।

পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের ওপর ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ আউটার রিং রোড নির্মাণে খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। চার লেইনের সড়কটি ৮৪ ফুট চওড়া।

শুরুতে নগরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে স্টিলমিল নারিকেলতলা-বেড়িবাঁধ (ফিডার রোড-১), বড়পোল-আনন্দবাজার-বেড়িবাঁধ (ফিডার রোড-২) এবং সাগরিকা-স্টেডিয়াম-বেড়িবাঁধ (ফিডার রোড-৩) নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল।

নানা জটিলতায় শুধু ফিডার-৩ এর কাজই এগিয়েছে। কিন্তু ওভারপাস জটিলতায় সেটিও চালু হয়নি।

ফিডার রোড চালু না থাকায়, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভিন্ন কন্টেইনার টার্মিনাল থেকে পতেঙ্গা হয়ে আউটার রিং রোডে উঠতে হয় পণ্যবাহী ভারী যানবাহনকে।

পাশাপাশি এই সড়কে চলাচলকারী যানবাহানকে নগরীতে প্রবেশের জন্য টোল রোড ধরে ফৌজদারহাট হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে সিটি গেইট হয়ে যেতে হয়। বিপরীতে নগরী থেকে আউটার রিং রোডে আসতে একই পথ ঘুরে আসতে হচ্ছে।

ওভারপাস দুটি নির্মাণে জটিলতার দ্রুত অবসান ঘটানোর তাগিদ দিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ এর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, চার লেইনের আউটার রিং রোড সাগরিকা অংশে দুই লেইনের টোল রোডের সঙ্গে মিশেছে, সেই অংশে এখনই গাড়ির চাপ খুব বেশি।

“ফলে দুটি ওভারপাসের বিষয়ে রেলওয়েকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ ডিসেম্বরে কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত টানেল চালু হয়ে গেলে আউটার রিং রোডে গাড়ির চাপ আরও অনেক বাড়বে।”

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, টানেল খোলার পর ওভারপাসগুলো চালু না হলে তখন গাড়ির চাপ আরও বাড়বে। সড়ক দুটির পুরো সুফল মিলবে না।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সাবেক এই সভাপতি বলেন, যখনই কোনো প্রকল্পের ডিপিপি (ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান) হয়, তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যাচাই করে মতামত দেয়।

“সেক্ষেত্রে রেল যদি পরে উচ্চতার পরিবর্তন করে, তাদের উচিত ছিল সেটা সিডিএকে অবহিত করা। আর সিডিএ যদি অনুমতি না নিয়ে থাকে, তাহলে তাদের উচিত ছিল রেলকে জানানো।

“এখন এ অবস্থায় যদি ওভারপাস দুটির অনুমতি না দেয়, তাহলে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণের করের টাকার এত বিপুল অপচয় করা উচিত হবে না।”

সমাধান কোন পথে?

সমস্যা সমাধানে রেলওয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটির এক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডবল ডেকার কন্টেইনার ট্রেন চালু হতে অন্তত ১০ বছর লাগবে। সেটা করতে শুধু এ দুটো নয় দেশের বেশিরভাগ ওভারপাসই বদলাতে হবে।

“ওভারপাস দুটি নির্মাণে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, তাই বর্তমান উচ্চতায় কাজ শেষ করতে আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও এই প্রস্তাব নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বলে জানি।”

কিন্তু পূর্ব রেলের ওই কমিটির সুপারিশ এখনও রেল মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি।

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, “এখন ওভারপাস দুটির কাজ শেষ করে, পরে যখন প্রয়োজন হবে তার দু’বছর আগে জানালে ভেঙে আবার ৮.৫ মিটার করার প্রস্তাবে আমরা রাজি ছিলাম।

“কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয় এখনও এতে সম্মতি দেয়নি। বাধ্য হয়ে আমরা আমাদের মন্ত্রণায়লকে (গৃহায়ন ও গণপূর্ত) চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। সেখান থেকে বিষয়টি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যাবে।”

জানতে চাইলে পূর্ব রেলের জিএম মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে আছে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।”

আরও খবর

Also Read: চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড: খরচ আর মেয়াদ বাড়ে, কাজ শেষ হয় না

Also Read: পাহাড় কেটে তৈরি সেই সড়ক ধসের শঙ্কায় হল বন্ধ