নতুন শর্ত এবং সফটওয়্যার হালনাগাদের কারণে চলতি বছরের শুরুতে জন্মনিবন্ধন ও সনদ ইস্যু কার্যক্রম মাসখানেকের জন্য বন্ধ থাকলেও এ সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিনটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু হয়।
Published : 28 Aug 2021, 11:07 PM
এগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর কেউই জানতেন না। এসব জন্ম সনদ কারা পেল, তা নিয়েও রয়ে গেছে ধোঁয়াশা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৬ নম্বর চকবাজার, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ও ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এসব জন্ম সনদ ইস্যু হয় বলে জানা গেছে। এসব ঘটনায় করা তিনটি মামলার তদন্ত করছে নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এসআই স্বপন কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সফটওয়্যার হ্যাক করে এসব জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করার শঙ্কায় জানিয়ে মামলা হলেও আমরা নিশ্চিত হয়েছি, সেটি হ্যাক হয়নি। কেউ তাদের পাসওয়ার্ড ও ইউজার আইডি ব্যবহার করে সফটওয়্যারে প্রবেশ করে জন্মসনদ ইস্যু করেছে।”
মামলার তদন্তে কিছুটা পিছিয়ে থাকার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আমরা সব জায়গায় অভিযান করতে পারিনি। সে কারণে অপরাধী শনাক্ত এবং ধরতে সময় লাগছে। তবে শিগগিরই এসব মামলার অগ্রগতি জানানোর আশা করছি।”
দেশে পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে প্রয়োজন হয় জন্মনিবন্ধন সনদ। রোহিঙ্গারা বিভিন্নভাবে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করেছে। বিভিন্ন সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছে বেশ কিছু রোহিঙ্গা।
তথ্য গোপন, ভুয়া তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে পাসপোর্ট আবেদন করে ছবি তুলতে গিয়েও বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জব্দ করা এসব জন্মনিবন্ধনের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ইস্যু করা।
রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যুর ঘটনায় বেশ কিছু মামলাও হয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। পুলিশের পাশাপাশি দুদকও এসব মামলার তদন্ত করছে।
অজ্ঞাতসারে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু হওয়ার ঘটনায় গত ৯ জুন একই দিনে চকবাজার থানায় একটি ও পতেঙ্গা থানায় দুটি মামলা করেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারীরা।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২২, ২৪, ২৬, ৩৩ ও ৩৪ ধারায় মামলাগুলো করা হয়েছিল।
তিনটি মামলায় অভিযোগ করা হয়, সফটওয়্যার হালনাগাদের জন্য গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে জন্মনিবন্ধন বন্ধ ছিল। যার কারণে ওই সময়ে কোনো জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়নি।
১ মার্চ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে নতুন করে পাসওয়ার্ড দেওয়ার পর জন্ম নিবন্ধন ও সনদ ইস্যুর কাজ শুরু হয়েছে।
নতুন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ইউজার আইডির মাধ্যমে সফটওয়্যারে প্রবেশের পর সংশ্লিষ্টরা জানতে পারেন, সফটওয়্যারের কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও ১৪ ফেব্রুয়ারি তিন ওয়ার্ড থেকে মোট ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু হয়।
জানা যায়, ইস্যু হওয়া সনদের মধ্যে সাতটি করে ১৬ নম্বর চকবাজার এবং ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে। আর চারটি ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে ইস্যু করা হয়।
এসব সনদের জন্ম নিবন্ধনকারীদের বয়স ১১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
চকবাজার ওয়ার্ডে ইস্যু হওয়া জন্মসনদগুলোর মধ্যে চারজন পুরুষ ও তিনজন নারী। উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে তিনজন পুরুষ, চারজন নারী ও দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে একজন পুরুষ ও তিনজন নারীর নামে এসব সনদ ইস্যু করা হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধনসমূহ বর্তমানে অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়। জন্মনিবন্ধনের যাবতীয় তথ্য জন্মনিবন্ধন সহকারীর আইডিতে আসে। অধিকতর যাচাইয়ের জন্য সেগুলো পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের আইডিতে।
কাউন্সিলর যাচাই-বাছাই করে নিবন্ধন নম্বর দিয়ে তা জন্মনিবন্ধন সহকারীর কাছে পাঠান। পরে নিবন্ধিত ব্যক্তির সনদ প্রিন্ট করা হয় এবং কাউন্সিলর স্বাক্ষর করেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী বলেন, কয়েকটি ওয়ার্ডে কিছু জন্মনিবন্ধন ইস্যুর ঘটনা ঘটেছিল। সেগুলো জানতে পারার পর সিটি করপোরেশনের নির্দেশে জন্মনিবন্ধন সহকারীরা মামলা করেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই স্বপন সরকার বলেন, জন্মনিবন্ধনের অনলাইন সফটওয়্যারে পাসওয়ার্ড থাকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের জন্মনিবন্ধন সহকারীর হাতে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি থেকে মাস খানেক সফটওয়্যারটি হালনাগাদের জন্য বন্ধ ছিল। মার্চ মাসে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে নতুন পাসওয়ার্ড দেওয়ার পর সফটওয়্যারের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়।
“কিন্তু বন্ধ থাকা অবস্থায় ১৬, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত ইউজার আইডিতে প্রবেশ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি এসব জন্মসনদ ইস্যু করা হয়।”
এসআই স্বপন বলেন, অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হলেও সেগুলো কাউন্সিলর কার্যালয়ের বালাম বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। কিন্তু এ ১৮টি জন্মসনদ সফটওয়্যারে থাকলেও তিন ওয়ার্ডের বালাম বইয়ে লিপিবদ্ধ না থাকায় বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে।
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, তিনটি ওয়ার্ডের ইউজার আইডিতে কোন আইপি থেকে প্রবেশ করা হয়েছে, তা জানতে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এসআই স্বপন বলেন, “তিনটি ওয়ার্ডের ইস্যু হওয়া এসব জন্মসনদ কী একজন ব্যক্তিই ইস্যু করেছে, নাকি তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি করেছে, কিভাবে ইস্যু হয়েছে এবং কাদের হাতে গেছে সেটা নিশ্চিত হতেই কাজ করছি। পাশাপাশি এসব জন্মনিবন্ধন সনদ কোনো রোহিঙ্গার হাতে গেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখছি আমরা।”