রোহিঙ্গাদের হাতে পাসপোর্ট: জালিয়াতির শুরু জন্ম নিবন্ধন সনদে

সম্প্রতি পাসপোর্ট করতে গিয়ে এক রোহিঙ্গা তরুণের জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা নজরে আসার পর এর ডেটাবেইজ পাসপোর্টের আবেদন যাচাই করার উপযোগী নয় বলে উঠে এসেছে পুলিশ থেকে শুরু করে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কথায়।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2019, 04:53 PM
Updated : 9 Sept 2019, 04:53 PM

পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট করাতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর মনসুরাবাদ পাসপোর্ট কার্যালয়ে আটক হওয়া রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ফয়সালের জন্ম নিবন্ধন সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে।

যে ওয়ার্ড থেকে ফয়সালের জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়েছিল, সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এএফ কবির আহমেদ মানিক বলছেন, এই সনদ তাদের হাত দিয়ে হয়নি।

ওই নিবন্ধন সনদ সংক্রান্ত তথ্য যাচাই শেষে কাউন্সিলর মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোহিঙ্গা তরুণের কাছ থেকে জব্দ করা জন্ম নিবন্ধন সনদটি আমাদের ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে দেওয়া হয়নি। প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে এ জন্ম সনদটি তৈরি করা।”

সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল লতিফপুরের স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে গত ২৯ অগাস্ট ফয়সাল পাসপোর্টের আবেদন করতে যান চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয়ে।

আবেদনের সাথে ফয়সাল ‘২০০০১৫৯৩৫২৫০৬১৫২০’ নম্বরের একটি জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দেন।

পাসপোর্টের আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া ফয়সালের জন্ম নিবন্ধন সনদটি অনলাইনে যাচাইয়ের পর তার তথ্য জন্ম নিবন্ধন ডেটাবেইজেও পাওয়া যায়। 

জন্ম নিবন্ধন সনদে প্রথম চার অঙ্কের নম্বর ব্যক্তির জন্ম সাল আর পরবর্তী সাত অঙ্ক ওয়ার্ড কোড; শেষ ছয় অঙ্ক নিবন্ধন নম্বর।

লালখান বাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক বলেন, “রোহিঙ্গা তরুণের কাছ থেকে জব্দ করা জন্ম সনদে ওয়ার্ডের কোড লেখা আছে ১৫৯৩৫২৫।

“আর লালখান বাজার ওয়ার্ড কোড ১৫৯১৬১৪। তাছাড়া ০৬১৫২০ নম্বরের কোনো সনদ লালখান বাজার ওয়ার্ড থেকে নিবন্ধিত হয়নি।”

তিনি বলেন, “জন্ম নিবন্ধন সনদ সরবরাহ করা হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জন্ম নিবন্ধন সহকারীর যৌথ স্বাক্ষরে। কিন্তু সনদটিতে জন্ম নিবন্ধন সহকারীর পরিবর্তে সচিবের স্বাক্ষর দেখানো হয়।”

সনদে থাকা দুটি স্বাক্ষর ও সিল জাল বলে দাবি করেন তিনি। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ফয়সালের দেওয়া জন্ম সনদে ব্যবহৃত ওয়ার্ড কোডটি ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের। 

রামপুর ওয়ার্ড কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘২০০০১৫৯৩৫২৫০৬১৫২০’ নম্বরের একটি জন্ম সনদ ইস্যু করা হয়েছিল ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর। আর আটক ফয়সালের কাছ থেকে জব্দ করা জন্ম সনদ ইস্যু ও নিবন্ধনের তারিখ চলতি বছরের ১৭ জুলাই।

রোহিঙ্গা তরুণের কাছ থেকে জব্দ করা সনদটিতে নিবন্ধন বই নম্বর ‘৬’ থাকলেও লালখান বাজার ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন বই নম্বর ‘১১’। আর ২০১১ সালে সরবরাহ করা মূল সনদটির নিবন্ধন বই নম্বর ‘৭’।

তবে রামপুরা ওয়ার্ডে ২০১১ ইস্যু করা সনদটির সঙ্গে রোহিঙ্গা ফয়সালের দেওয়া সনদের মধ্যে তথ্যগত বেশকিছু মিল আছে। দুটি সনদেই নিবন্ধিত ব্যক্তির বাবা-মার নাম, জন্ম তারিখ ও ঠিকানা একই।

রামপুরা ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী সুমন কান্তি গুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “এ সনদে ‘১৫৯৩৫২৫’ নম্বরের যে ওয়ার্ড কোডটি ব্যবহার করা হয়েছে তা ছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১৪ সাল থেকে অনলাইন হওয়ায় নতুন অন্য ওয়ার্ড কোড ব্যবহার হয়।”

জন্মনিবন্ধন সহকারী সুমন গুপ্তেরও দাবি, রোহিঙ্গা যুবকের কাছ থেকে জব্দ করা সনদটি ‘প্রযুক্তির অপব্যবহারে’ মাধ্যমে তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে। 

এ ধরনের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে মানিক বলেন, “জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাইয়ে অনলাইনে যে দুর্বলতা তার কারণে এ ধরনের জালিয়াতি সম্ভব হচ্ছে বলে ধারণা করছি।”

জন্ম নিবন্ধন ডেটাবেইজে ঘাটতির পাশাপাশি পুরো প্রক্রিয়ার সাথে একটি দালাল চক্র জড়িত থাকার কারণে এ ধরনের জালিয়াতি সম্ভব হচ্ছে বলেও দাবি করেছে সংশিষ্টরা।

তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের আগে এ সংক্রান্ত তথ্য পুলিশের বিশেষ শাখা, পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জানা ছিল না। তাদের অন্ধকারে রেখেই চক্রটি এ ধরনের নিবন্ধন সনদ যোগাড় করে দিত রোহিঙ্গাদের জন্য।

আগামী ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বার্ষিক সাধারণ সভায় নিবন্ধন প্রক্রিয়া এবং জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত জালিয়াতির বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান মানিক।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যালয়ের পরিচালক আবু সাইদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাসপোর্ট আবেদনের সাথে জমা দেয়া জন্ম নিবন্ধনটির নম্বর দিয়ে ডাটা বেইজে তা আছে কি না, সেটা আমরা যাচাই করতে পারি। এতে নাম, বাবা-মার নাম আর জেলা প্রদর্শিত হয়। সুনির্দিষ্ট ওয়ার্ড বা ঠিকানা প্রদর্শিত হয় না।

“ফলে এভাবে সনদ নম্বর ঠিক রেখে কেউ ওয়ার্ড পরিবর্তন করলে তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই।”

জমা দেওয়া নিবন্ধন অনলাইনে নেই

ফয়সালের মতো পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট আবেদন করা কয়েকজন রোহিঙ্গার জন্ম নিবন্ধন সনদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে আছে।

এর কয়েকটি নিয়ে যাচাই করা হয়। এরমধ্যে কয়েকটির কোনো তথ্যই জন্ম নিবন্ধন ডেটা বেইজে নেই। যেগুলোর তথ্য ডেটা বেইজে আছে তার মধ্যে কয়েকটিতে নানা রকম অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মঞ্জুর মোর্শেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “সনদ অনলাইনে যাচাইয়ে পদ্ধতিগত দুর্বলতা আছে। এ কারণে এক শ্রেণির অসাধু লোক এর সুযোগ নিচ্ছে।”

তিনি বলেন, “যদিও পাসপোর্ট ক্লিয়ারেন্সের জন্য জন্ম নিবন্ধনের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা হয় না। জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি প্রাপ্ত বয়স্কদের জাতীয় পরিচয়পত্র, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে শিক্ষা সনদ, মা-বাবার জাতীয়তা সনদসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য যাচাই করে পাসপোর্ট ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়।”

মোর্শেদ বলেন,  “অনলাইন যাচাই সার্ভারে নাম, মা-বাবার নাম ও জন্মস্থান প্রদর্শিত হয়।

“এর পাশাপাশি ওয়ার্ড নম্বর ও বিস্তারিত ঠিকানা এবং ছবি প্রদর্শিত হলে কোনো প্রতারণার সুযোগ পাওয়া যেত না।”

তবে ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ’ বিষয়টি আমলে নেবেন বলে মনে করছেন পুলিশের বিশেষ শাখার এই অতিরিক্ত উপ-কমিশনার।