চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গল লতিফপুর এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন মো. ফয়সাল। আবেদনে জমা দেন অনলাইন জন্ম নিবন্ধন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তার সনদও। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপ দিতে গেলে তা মিলে যায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ডাটাবেইসে থাকা একটি ছাপের সঙ্গে; অর্থাৎ তিনি রোহিঙ্গা।
Published : 05 Sep 2019, 09:51 PM
ফয়সালে ঘটনাটি গত ২২ অগাস্টের; চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে বৃহস্পতিবার ধরা পড়েন শফিকুল হাই নামে আরেকজন। তিনিও জাতীয় পরিচয়পত্র ও জাতীয়তার সনদ জমা দেন পাসপোর্ট করাতে। কিন্তু পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদে নিজের রোহিঙ্গা পরিচয় স্বীকার করেন শফিকুল।
পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয়তার সনদের মতো শর্তগুলো নিয়েই পাসপোর্ট করাতে আসছেন রোহিঙ্গারা। ভুয়া নাম-ঠিকানা নিয়ে সিটি করপোরেশন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে এই সনদ নিয়ে আসছেন তারা। ফলে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ভিড়ে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তারপরও কথায় সন্দেহ হলে কিংবা রোহিঙ্গা ডাটাবেইসের সঙ্গে মিলিয়ে পাসপোর্টের ভুয়া আবেদন শনাক্ত করা হচ্ছে। গত এপ্রিল থেকে অগাস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার দুটি পাসপোর্ট কার্যালয়ে আবেদনকারী একশ’র মতো ব্যক্তিকে রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক করা হয়েছে।
পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক হওয়া ব্যক্তিদের প্রত্যেকেরই ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নেওয়া সনদ পাওয়া গেছে। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাসপোর্ট পাওয়া ঠেকাতে মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোকে কঠোর হতে হবে। এজন্য ওয়ার্ড পর্যায়ে সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও জোরালো হওয়া প্রয়োজন।
শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে থাকা ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাওয়ার কিছু ঘটনা আগেও ঘটেছিল। তখন সতর্কতা অবলম্বনের কথাও বলা হচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এক সঙ্গে অনেক ঘটনা ধরা পড়ার স্পষ্ট হয়, সেই সতর্কতায় কাজ হয়নি।
এখন সবগুলো কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেছেন, এখন থেকে কাউকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের ডাটাবেইসে মিলিয়ে দেখা হবে। এতে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হবে।
তবে পাসপোর্টের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের বিকল্প হিসেবে জন্ম নিবন্ধন কিংবা জাতীয়তার সনদও গ্রহণ করা হয় বলে সেখানকার ফাঁকগুলো বন্ধের উপর এখন জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামের দুটি পাসপোর্ট অফিসের মধ্যে মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের অধীনে হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই ও সন্দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দারা পাসপোর্টের আবেদন করতে পারেন।
এছাড়া মহানগরীর ডবলমুরিং, বন্দর, পতেঙ্গা, বায়েজিদ বোস্তামী, পাহাড়তলী, হালিশহর ও আকবর শাহ থানা এ কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে পাঁচলাইশের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অধীনে বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী উপজেলা এবং নগরীর কোতোয়ালী, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, পাঁচলাইশ ও কর্ণফুলী থানা এলাকা।
চট্টগ্রাম পাঁচলাইশের আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে গত এপ্রিল থেকে অগাস্ট পর্যন্ত ২৮ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করে পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। যার মধ্যে আটজন নারী, আর বাকিরা পুরুষ।
একই সময়ে মনসুরাবাদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস থেকেও ৫০ জনের মতো রোহিঙ্গা আটক করে পুলিশের হাতে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আবু সাইদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের পাসাপোর্ট আবেদনের সাথে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিচ্ছেন।
“এগুলোকে ভুয়া বলা যায় না। কিন্তু আবেদনকারীর চালচলন ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে আমরা তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি।”
মনসুরাবাদ পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল তার যে অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দিয়েছিলেন, তা ইস্যু করা হয়েছে নগরীর ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড থেকে। আর জাতীয়তা সনদ জমা দিয়েছে সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের।
ফয়সাল তার পাসপোর্ট আবেদনে তার মা, বাবারও জাতীয় পরিচয়পত্রও জমা দিয়েছে।
পরিচালক আবু সাইদ বলেন, “ফয়সাল তার পাসপোর্ট আবেদনে বাবার নাম উল্লেখ করেছিল মো. নাসিম আর মার নাম শমজিদা বেগম। কিন্তু শরণার্থীদের নিবন্ধন কার্ড অনুযায়ী ফয়সালের বাবার নাম সোনা মিয়া এবং মার নাম আনোয়ারা বেগম।”
ফয়সাল পুলিশকে জানান, চার বছর বয়সে বাবা, মার সঙ্গে বাংলাদেশে এসে উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেও পরে থাকতেন বান্দরবানের সীমান্তবর্তী উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়িতে। সেখান থেকে চট্টগ্রামে এসে এসব জোগাড় করে পাসপোর্টের আবেদন করেন।
বৃহস্পতিবার আটক হওয়া শফিউল পাসপোর্ট আবেদনে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে জাতীয়তা সনদও জমা দিয়েলেন ফটিকছড়ি উপজেলার আব্দুল্লাহপুরের ঠিকানা ব্যবহার করে। ধরা পড়ার পর তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে ২০১৪ সালে আসার পর মা, বাবা, ভাই, বোনসহ পাঁচজন উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে পরে তারা ফটিকছড়িতে চলে যান।
গত ২২ অগাস্ট সুমাইয়া আক্তার নামে আটক এক রোহিঙ্গা নারীর পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে দেওয়া জন্ম নিবন্ধন সনদটি ইস্যু করা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ড থেকে।
পাঁচলাইশ পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের হাতে রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক ২৮ জনের মধ্যে ১২ জন তাদের পাসপোর্ট আবেদনের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিয়েছে, বাকিরা দিয়েছে জন্মনিবন্ধন সনদ।
পাঁচলাইশের আঞ্চলিক কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক আল আমিন মৃধা বলেন, “ রোহিঙ্গা সন্দেহে যাদের আমরা আটক করছি তাদের পাসপোর্ট আবেদনের সাথে দেয়া তথ্যগুলো আমাদের যাচাই করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। যাদের তথ্যগত গড়মিল আছে এবং সন্তোষজনক জবাব দিতে পারে না, তাদের আমরা রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি।
“রোহিঙ্গারা যাতে জন্ম, জাতীয়তা সনদ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে না পারে সেজন্য মাঠ পর্যায়ের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তিকে সনদ দেওয়ার আগে তার দেওয়া তথ্য ঠিক আছে কি না, সেটা জনপ্রতিনিধিরা যাচাই করে নিলে সহজেই রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবে না।”
এদিকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট আবেদন ঠেকাতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান পাসপোর্ট কর্মকর্তারা।
আবু সাইদ বলেন, পাসপোর্ট আবেদনকারীদের ফরম সংগ্রহের সময় সব কর্মকর্তাদের কিছু বিষয় অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে, আবেদনকারীর অনুপস্থিতিতে যেন কোনো আবেদন গ্রহণ করা না হয়। অসম্পূর্ণ আবেদন ফরমও না নিতে বলা হয়েছে।
রোহিঙ্গা আবেদনকারীদের শনাক্ত করতে পারলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রণোদনামূলক পুরস্কারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানান পরিচালক আবু সাইদ।
রোহিঙ্গারা যাতে সহজে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে না পারে, সেজন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার আব্দুল ওয়ারিশ।
তিনি বলেন, “অনেক সময় কাউন্সিলর কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের কাউন্সিলর কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলে অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন সনদ সংগ্রহ করে ফেলছে। তারপরও সেগুলো তদন্ত করার অনেক সুযোগ রয়েছে।”
তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের কড়া নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সকল তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত না করে যেন কোনো প্রতিবেদন না দেয়।