রোহিঙ্গা ডেটাবেইজে মেলানোর পরই এনআইডি: ডিজি

ভোটার তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে নাগরিকদের তথ্য ও আঙ্গুলের ছাপ রোহিঙ্গা ডেটাবেইজে ‘ক্রস ম্যাচ’ করেই নির্বাচন কমিশনের মূল তথ্যভাণ্ডারে নেওয়া হবে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2019, 06:16 PM
Updated : 4 Sept 2019, 07:04 PM

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকাভুক্ত ও জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার খবর বেরিয়ে আসার মধ্যে একথা জানালেন ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।

বর্তমানে দেশের ১০ কোটি ৪২ লাখেরও বেশি নাগরিকের তথ্য রয়েছে ইসির তথ্যভাণ্ডারে। পাশাপাশি হালনাগাদের আরও ৮০ লাখ নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ চলছে দেশজুড়ে।

অন্যদিকে কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে থাকা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক ডেটা রয়েছে সরকারের কাছে।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালকের কথা অনুযায়ী কাজ হলে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের কারও ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে না, আর পাসপোর্ট করতে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে বলে মিয়ানমারের এই নাগরিকদের তা করার সুযোগও বন্ধ হবে।

ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটার তালিকাভুক্ত করার জন্য নিবন্ধিত নাগরিকদের তথ্য সার্ভারে আপলোড যখনই হচ্ছে, তার আগে পর্যায়ক্রমে চেক করে আপলোড দেওয়া হবে। রোহিঙ্গা সার্ভারে আবার চেক করে মূল সার্ভারে আপলোড দেওয়া হবে।

“সুতরাং কোনো রোহিঙ্গার এনআইডি পাওয়ার সুযোগ নেই। অন্য কোনো জায়গা থেকে ফাঁকি দিয়ে এলেও আমাদের সার্ভার ফাঁকি দিতে পারবে না।”

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম

প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে ব্রিগেডিয়ার সাইদুল জানান, ভোটার তালিকায় না ওঠানোর আগে রোহিঙ্গা সার্ভারে ঢুকে তারা ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলিয়ে দেখবেন, না মিললেই জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।

“রোহিঙ্গারা কোথাও পালিয়ে গিয়েও যেন ভোটার হতে না পারে সেজন্য রোহিঙ্গা সার্ভারেও আমরা এক্সেস করব। রোহিঙ্গাদের ডাটাবেইজ তৈরি হয়ে গেছে। সেটা ডেটাবেইজও আমরা সার্চ করতে যাচ্ছি। রোহিঙ্গা সার্ভারে যদি ‘নো’ হয় তাকে মূল সার্ভারে এলাও করা যাবে। ভোটার হওয়ার জন্য ডেটা আপলোড করা হবে।”

“উদ্বেগের কিছু নেই, আমরা সতর্ক,” সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক।

নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে ভুয়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করিয়ে ফেলেছেন। কেউ কেউ পাসপোর্ট করে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন।

ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহের সময় সতর্ক থাকার কথা বলা হলেও রোহিঙ্গাদের ঠেকানো যায়নি।

চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকাভুক্ত হয়ে এনআইডি পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারে এক রোহিঙ্গার স্মার্ট কার্ডও মিলেছে। এরইমধ্যে চট্টগ্রামে ইসির সার্ভারে বেশ কিছু নাগরিকদের তথ্যেও অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।

যে কারণে অর্ধশত নাগরিকের ভোটার তথ্য সার্ভারে আটকে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

এপরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাইদুল সার্বিক বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ তুলে ধরেন।

ইসির প্রশাসনিক শাখার একজন উপসচিবকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা তদন্ত করে দেখবে, পাশাপাশি সার্ভারে আমাদের আইসিটি টিম কাজ করছে। ইসির আইসিটি শাখাই ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত নাগরিকের ভুয়া তথ্য শনাক্ত করেছে। তারা সার্ভারে তথ্যে অসঙ্গতি পেয়েছে; এসব নাগরিকের এনআইডি ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।”

ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, “তারা কিন্তু আইডি পায়নি। কেবল ডেটা আপলোড করেছে; আমাদের এএফআইএস (অটোমেটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ) ম্যাচিংয়ে তারা ধরা পড়েছে। এরপর আমরা ব্লক করে দিয়েছি।”

তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহের পথ করে দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দেন এনআইডি ডিজি।

ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, “সার্বিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে কারও কোনো গাফলাতি রয়েছে কি না, বিশেষ কমিটির মধ্যে কোনো গ্যাপ রয়েছে কি না, কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখব।”

গোড়ায় গলদ, তদন্ত প্রক্রিয়াধীন

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ছবিসহ ভোটার তালিকা শুরুর পর কিছু ফাঁকফোকর গলে কিছু রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে। কক্সবাজারেই ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সালে লক্ষাধিক আবেদন বাতিল করেছে বিশেষ কমিটি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তদন্তেও রোহিঙ্গাদের ভোটার করার তথ্য মিলেছে।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার করার সময় স্থায়ী বাসিন্দাদের সহযোগিতা থাকলে এবং নিবন্ধন ও নাগরিক সনদ থাকলে কাউকে ভোটার করা থেকে আটকানো মুশকিল। কেউ ভোটার হতে পারলেই এনআইডি পেয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ভোটার করার সময় নজরদারি ও সঠিকতা নিশ্চিত করতে পারলেই রোহিঙ্গাদের আটকানো যাবে।

বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের

রোহিঙ্গাদের ভোটার করায় সম্পৃক্ত অসাধু ব্যক্তি কিংবা অননুমোদিত লোক সার্ভারে প্রবেশ করে তথ্য সংশোধন বা অন্যদের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এনআইডি দেওয়ার অভিযোগও গণমাধ্যমে এসেছে।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন দায়ীকে শনাক্ত করে কখনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার নজির নেই। দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পের কিছু লোককে বরখাস্ত ও কর্মকর্তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে এনআইডি উইং মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল বলেন, “জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার সুরক্ষিত, যারা রক্ষণাবেক্ষণ করছে তারাই এখন মূল নির্ভরের জায়গা। আমাদের এখানে যেই কাজ করুক সবাইকে ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখি। কমিশন ছাড়া তো কেউ সার্ভারে ঢুকতে পারে না।”

এনআইডি উইংয়ের ইসির একজন কর্মকর্তার বিষয়ে, বরিশাল ও চট্টগ্রামের ঘটনা তদন্তাধীন বলে জানান তিনি।

“তদন্ত প্রক্রিয়াধীন, প্রতিবেদন দিলে ব্যবস্থা নেব। এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা হয়নি। ১০-১২ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন পেতে পারি।”

রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ কীভাবে ভোটার হয়েছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান এনআইডি উইং ডিজি।

তিনি বলেন, “সে ভোটার হয়েছে, এনআইডি পেয়েছে; স্মার্টকার্ডও ২০১৬ সালে হয়েছে। তখন তো সার্ভার এত উন্নত ছিল না। সুতরাং কীভাবে ভোটার হয়েছে, কারও কোনো প্রশ্রয় পেয়েছিল কি না, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। এ নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে।”

আরও খবর