এনআইডি জালিয়াতিতে ‘সর্ষেয় ভূত পেয়েছে’ দুদক

চট্টগ্রামে এনআইডি জালিয়াত চক্রের ‘খোঁজ পাওয়ার’ কথা জানিয়ে তা তদন্তের অনুমতি চেয়ে ঢাকায় চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আঞ্চলিক কার্যালয়।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2019, 03:04 PM
Updated : 18 Sept 2019, 05:30 PM

দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রাথমিক তদন্তে তারা এনআইডি জালিয়াত চক্রের সঙ্গে নির্বাচন কার্যালয়ের ‘বড় দুটি সিন্ডিকেট’ জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছেন।

“সিন্ডিকেটের বিষয়টি তদন্তের জন্য আমরা ঢাকায় অনুমতি চেয়ে চিঠি দিচ্ছি। অনুমতি পেলেই আমরা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করব।”

শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজারে থাকা অনেক রোহিঙ্গার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) করে পাসপোর্ট নেওয়া এবং ভুয়া এনআইডি’র তথ্য ডাটা বেইসে থাকার ঘটনা তদন্তের উদ্যোগ ইতোমধ্যে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা সন্দেহে অন্তত অর্ধশত এনআইডি বিতরণ আটকে দেয় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। 

রোহিঙ্গাদের টাকার বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির তথ্য প্রকাশের পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে অনুসন্ধানে যায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। এসময় তারা ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও কথা বলেন।

এরপর গত সোমবার রাতে জয়নাল আবেদীন নামে এক অফিস সহায়ক ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে পুলিশে দেয় চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। জয়নালের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানায়, চাকরির সুবাদে ঢাকায় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের অধীনে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সাগর ও সত্য সুন্দর নামে দুই ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সাগরের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় একটি ল্যাপটপ কেনেন তিনি। তার মাধ্যমে তিনি ডেটা তৈরির কাজ করে ঢাকায় পাঠাতেন।  

তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা যে মামলা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, “জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল আবেদীন জানায়, চট্টগ্রাম অফিস থেকে সে ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড প্রতি শুক্র, শনিবারসহ বন্ধের দিনগুলোতে গোপনে তার বাসায় নিয়ে যেতেন। বাসায় বসে সে ল্যাপটপের সাথে উল্লেখিত সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করে ডেটা তৈরি করে মেইলে ঢাকায় সাগরের কাছে পাঠাতেন।”

সাগর নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে তথ্যাদি আপলোডসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রিন্ট কপি এসএ পরিবহনের মাধ্যমে জয়নালের কাছে পাঠিয়ে দিতেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

বলা হচ্ছে, প্রতিটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য জয়নাল রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে নিতেন।

দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা চট্টগ্রাম নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৬৮ জনের একটি তালিকা সংগ্রহ করেছেন। এ তালিকায় একজন ছাড়া বাকি সব রোহিঙ্গা নাগরিক।

নাম প্রকাশ না করে এক দুদক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ২০১২ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলা থেকে চারটি এবং রাঙামাটি ও কাপ্তাই থেকে দুটিসহ মোট ছয়টি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়।

এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর টেকনাফে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ‘ডাকাত’ নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে উদ্ধার করা স্মার্ট কার্ডের বিষয়টি নিয়েও দুদক কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন, নূর মোহাম্মদ ২০১৬ স্মার্ট কার্ড সংগ্রহ করেন চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে। ৪৩৯১ নম্বরের একটি ল্যাপটপ থেকে তাকে ভোটার করা হয়েছে।

এ ল্যাপটপের বিষয় নিয়ে চট্টগ্রামের নির্বাচন কর্মকর্তারা কিছুই জানাতে পারেননি দুদক কর্মকর্তাদের। তবে এ ধরনের কোন ল্যাপটপ ২০১৪ সালের পর থেকে চট্টগ্রামে ব্যবহার করা হয়নি বলে নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান।

নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেইসে লাকী নামে যে রোহিঙ্গা নারী তথ্য পাওয়া গেছে তার নিবন্ধন ফরম নম্বর ছিল ৪১৮৬৬৩৬৮। নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের ধারণা, ওই নিবন্ধন বইয়ের ৪১৮৬৬৩৬০ খেকে ৪১৮৬৬৩৯৩ নিবন্ধন ফরম নম্বরের সবাই রোহিঙ্গা।

৪১৮৬৬৩৬০ নম্বর নিবন্ধন ফরমের ফয়জুল্লাহ নামের ব্যক্তির। যিনি কক্সবাজার ইসলামপুরের বাসিন্দা হলেও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

দুটি চক্র

দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা প্রাথমিক তদন্তের জয়নালের পাশাপাশি আরও এক ব্যক্তির নাম পেয়েছেন। এই দুজন ‘সিন্ডিকেট’ করে রোহিঙ্গাদের ভোটার করছেন।

এই দুজনের কয়েকজন আত্মীয় বিভিন্ন জেলার নির্বাচন কার্যালয়ে কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ জড়িত বলেও মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা।

তারা জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির ক্ষেত্রে দুই নম্বর ফরমটি জমা নির্বাচন কার্যালয়ে। সে ফরমটি ডাটাবেইসে আপলোড দেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। বিভিন্ন রোহিঙ্গা ব্যক্তির তথ্যগুলো নির্বাচন কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া আপলোড করা সম্ভব নয়। 

জয়নাল আবেদীনসহ এই তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে

জয়নালকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মঙ্গলবার পুলিশ জানিয়েছিল, জয়নালের মোট ১৬ জন আত্মীয় বিভিন্ন জেলার নির্বাচন কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জকরিয়া সম্পর্কে তার মামা। ২০০৪ সালে জয়নালের পাশাপাশি তার বেশ কয়েকজন  স্বজন নির্বাচনী কার্যালয়ে চাকরি পান।

দুদক উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে তারা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নির্বাচন কার্যালয়ের যেসব কর্মকর্তা, কর্মচারীর নাম পেয়েছেন, তাদের সবার সম্পদের অনুসন্ধান করবেন।”

পাশাপাশি ২০১৫ সাল থেকে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কার্যালয় থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, কী পরিমাণ বিভাগীয় মামলা হয়েছে, তার সবগুলো খতিয়ে দেখবেন।

দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি চান জকরিয়া

এনআইডি জালিয়াতিতে গ্রেপ্তার জয়নাল ২০০৬ সালে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব ও পরে ওএসডি হওয়া মো. জকরিয়া বলছেন, এই অপরাধে যারা যুক্ত তিনি তাদের শাস্তি চান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৩ বছর ধরে ইসির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই। এখন কী হচ্ছে, তা নিয়েও ধারণা নেই। আমার বাড়ি যেহেতু বাঁশখালীতে, সেখানে আত্মীয় স্বজন রয়েছে। তবে কেউ যদি কিছু করে দায় তার।

“আমিও চাই দৃষ্কৃতকারীর শাস্তি হোক। এটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনোভাবেই অপরাধীদের ছাড় দেওয়া যাবে না। সেটা যেই হোক- আমিও এগুলোর শাস্তি চাই।”

জকরিয়া বুহল সমালোচিত এমএ আজিজ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সময় ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে প্রায় ১০ বছর ওএসডি থাকতে হয় তাকে।