চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভার আগে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার মামলায় ৩১ বছর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
Published : 14 Jan 2020, 07:02 PM
লালদীঘি গণহত্যা: ৩০ বছরেও শেষ হয়নি মামলার বিচার
লালদীঘির ২৪ হত্যা: বিচারের অপেক্ষায় তিন দশক
লালদীঘির ২৪ হত্যা: আসামির ‘মৃত্যু প্রতিবেদন’ আসেনি ছয় মাসেও
মঙ্গলবার চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ ইসমাইল হোসেনের আদালতে এই মামলার ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আইনজীবী শম্ভুনাথ নন্দী।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্তের আবেদন করলে আদালত তাতে সায় দেন।
তারপর রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের ৩৪২ ধারায় যাচাই করেন। শেষে বিচারক ১৯ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য সময় নির্ধারণ করেছেন। যুক্তিতর্ক শেষে রায় হবে।
বিশেষ জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অ্যাডভোকেট শম্ভুনাথ নন্দী প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দেন।
“দীর্ঘদিন ধরেই মামলাটির কার্যক্রম চলছে। আরও সাক্ষী ছিল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য হয়ে যাওয়ায় আর সাক্ষী নিতে চাইনি। আদালত তাতে সায় দিয়েছেন। আশা করি, দ্রুত রায় ঘোষণা করা হবে।”
আগামী ২৪ জানুয়ারি লালদীঘি গণহত্যার দিনটির ৩২ বছর পূর্ণ হবে।
মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে আইনজীবী শম্ভুনাথ নন্দী বলেন, “ঘটনার দিন সেসময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আসছেন শুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম।
“শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক যখন এগিয়ে আসছিল। তখন অয়্যারলেস সেটে তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে পুলিশ ট্রাক লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে।”
এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্দরনগরীর লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল। ওইদিন বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি আদালত ভবনের দিকে আসার সময় গুলিবর্ষণ শুরু হয়।
বিভিন্ন সময় এই মামলার সাক্ষীরা আদালতে বলেছেন, ওইদিন পুলিশের গুলিতে মোট ২৪ জন মারা যান।
গুলিবর্ষণের পর আইনজীবীরা মানববেষ্টনি তৈরির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে রক্ষা করে তাকে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
গুলিতে নিহতদের কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। হিন্দু-মুসলিম নির্বিচারে সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। কিন্তু বিএনপি সরকারের সময়ে মামলার কার্যক্রম এগোয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়।
আদালতের আদেশে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম এবং অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেয়, যাতে আসামি করা হয় আট পুলিশ সদস্যকে।
আট আসামি হলেন- চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালি অঞ্চলের পেট্রোল ইন্সসপেক্টর জে সি মণ্ডল, কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মুশফিকুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন।
এদের মধ্যে রকিবুল হুদা, বশির উদ্দিন ও আব্দুস সালাম মারা গেছেন। জে সি মণ্ডল পলাতক আছেন। বাকি চারজন আদালতে নিয়মিত হাজিরা দেন।
মামলার বাদী শহীদুল হুদা মারা গেছেন। মারা গেছেন সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আব্দুল কাদেরও।
এ মামলায় ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে একজন করে মোট দুজন, ২০০০ সাল থেকে গত ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪৪ জন সাক্ষ্য দেন। এরপর গত এক বছরে আরও সাতজন সাক্ষ্য দেন।
২০০১ সালের মে থেকে ২০০৬ সালের ২৩ অগাস্ট এবং ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এ মামলায় কারও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
তারপর ২০১৬ সালে মামলাটি চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসার পর আবার সাক্ষ্যগ্রহণ গতি পায়।
এরমধ্যে ২০১৬ সালের ২৬ জুন সাক্ষ্য দেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
তারপর নিহতের মা শেফালী সরকার, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, সুভাষ চন্দ্র লালা, নিহতের ভাই অশোক কুমার বিশ্বাস, নিহতের মা হাসনা বানু, নিহতের ভাই মাঈনুদ্দিন, আবু সৈয়দ এবং অশোক বিশ্বাস সাক্ষ্য দেন।
এছাড়াও সাক্ষী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, আখাতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং আতাউর রহমান খান কায়সারের নাম ছিল। তারা গত কয়েক বছরে মারা গেছেন।
চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ কমিশনার ও মামলার আসামি রকিবুল হুদার নির্দেশে ওই ঘটনা ঘটানো হয় বলে দাবি করেন মোশাররফ।
ওই দিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন- মো. হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মো. কাসেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত।