মহিউদ্দিন-নাছিরের ঝগড়ায় ‘ক্ষতির শঙ্কা’ আ. লীগে

সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের পুরনো বিরোধ সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি আক্রমণে নতুন মাত্রা পাওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ।

মিন্টু চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2017, 01:13 PM
Updated : 13 April 2017, 01:21 PM

স্থানীয় নেতারা বলছেন, শীর্ষ দুই নেতার এই ‘ব্যক্তিগত বিরোধের’ ফলে কর্মীদের মধ্যে বিভক্তি বাড়ছে, যা দলকে সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা এ বিষেয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। আর দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, মহিউদ্দিন-নাছিরের এই বিষোদগার ‘দুঃখজনক’, দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারাও এ বিষয়ে অবগত।

চট্টগ্রাম মহানগরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনবারের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের বিবাদের ইতিহাস এক দশকের পুরনো। 

মহিউদ্দিন যখন মেয়র ছিলেন, তখনও ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে নাছিরের সঙ্গে তার দূরত্বের খবর পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে।

দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে মহিউদ্দিনের বদলে মনোনয়ন দেন নাছিরকে। কেন্দ্রের নির্দেশে মহিউদ্দিন সে সময় নাছিরের পক্ষে প্রচারেও নামেন।

কিন্তু নির্বাচনের আগে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর বিরোধিতা করা নাছির গত বছর নগরজুড়ে জমি ও স্থাপনার হোল্ডিং ট্যাক্স পুনঃনির্ধারণের ঘোষণা দিলে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা শুরু করেন মহিউদ্দিন।

সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে মেয়র নাছির নগরীর পাথরঘাটা থেকে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র রাজাখালে সরিয়ে নিলে মার্চে তা আগের স্থানে ফিরিয়ে আনেন সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন। তখন থেকেই দুই নেতার বিবাদ প্রকাশ্যে চরম আকার ধারণ করে।

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যেসব বিষয় নিয়ে বাহাসে জড়িয়েছেন তা সাংগঠনিক বিষয় নয়। কিন্তু তাদের এই দ্বন্দ্ব দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

তিনি বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের যে মতবিরোধ, তা নিয়ে যে কোনো ফোরামে আলোচনা হতে পারে। দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা হলে সেখানেও তারা নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পারতেন, একে অপারের বিরুদ্ধে বলতে পারতেন। 

‘ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি’ বন্ধ করে দলীয় বা ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের ওপর জোর দেন সুজন।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দেখভালের দায়িত্বে আছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির দুজনেই চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল নেতা। তাদের বক্তব্য এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যাওয়া দুঃখজনক। এতে তো দলেরও ক্ষতি হয়।”

কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দুই জনের সঙ্গেই কথা বলা হয়েছে জানিয়ে শামীম বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদকও এ বিষয়ে অবগত। সুতরাং প্রকাশ্যে বিতণ্ডায় না জড়িয়ে দলীয় ফোরামে বা ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করলেই তারা ‘ভালো করবেন’।

সোমবার লালদীঘি মাঠে এক সমাবেশ থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরী তার সাধারণ সম্পাদক নাছিরকে ‘খুনি’ আখ্যায়িত করেন। তার অভিযোগ, নাছিরের তত্ত্বাবধানে ১২টি খুন হয়েছে।

নাছিরকে ‘অথর্ব’ আখ্যায়িত করে তাকে মেয়র পদ থেকে অপসারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠানোর কথাও মহিউদ্দিন বলেন। 

এর পাল্টায় মেয়র নাছির খুনের প্রমাণ দেওয়ার আহ্বান জানান। মহিউদ্দিনের বক্তব্যকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি।

এরপর মঙ্গলবার দুপুরে মহিউদ্দিন চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, নাছিরের হাত দিয়ে মানুষ খুন হওয়ার প্রমাণ তার কাছে আছে।

তিনি নাছিরের সিটি করপোরেশনকে ‘পাগলের আড্ডাখানা’ বলায় করপোরেশনের কাউন্সিলররা বৃহস্পতিবার মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন এবং সাবেক মেয়রের সময়ে ‘নালা-নর্দমা দখল করে গড়ে তোলা স্থাপনা’ অপসারণের সিদ্ধান্ত জানান।

তাদের এই পাল্টাপাল্টি বাক্যবাণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সংসদ সদস্য আফসারুল আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা ব্যক্তিগতভাবে এসব বলছেন, এতে দলীয় বিষয় নাই। কিন্তু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাদের এসব বক্তব্যে দলের নেতাকর্মীরা, মানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী, শেখ হাসিনার কর্মীরা বিব্রত হবেন।” 

নগর কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের এই মুখোমুখি অবস্থান দলের নেতাকর্মীদের জন্য ‘সুখকর কিছু নয়’।

“প্রধান দুই নেতার এ দ্বন্দ্ব দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ দিন দিন বাড়াচ্ছে, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, এটা ভাল নয়। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ হস্তক্ষেপ করে এ সমস্যার সামধান করবেন বলে আশা করি।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন তাদের দল সরকারে থাকলেও ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে সাংগঠনিক অবস্থা ভাল নয়।

“চট্টগ্রাম মহানগরের এ দুই নেতার বিরোধ পুরনো। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে তারা যা করছেন, তা কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উস্কে দেবে। এখনই তা না ঠেকালে ভবিষ্যতে চড়া মাশুল দিতে হতে পারে।”