একাত্তরে চট্টগ্রামের বদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ডালিম হোটেলে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক ও হিন্দুদের ধরে এনে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করা হত।
Published : 08 Mar 2016, 01:04 PM
ওই সময় জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ চট্টগ্রামের সভাপতি মীর কাসেমের নেতৃত্বে আরও তিনটি জায়গাকে ‘টর্চার সেল’ বানানো হয়েছিল।
তবে নির্যাতনের ভয়াবহতার দিক থেকে আন্দরকিল্লার পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডের ডালিম হোটেল অন্যগুলোকে হার মানায়।
চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই এলাকায় দোস্ত মোহাম্মদ ভবন, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলেও ছিল নির্যাতন কেন্দ্র।
চট্টগ্রাম শহরের কোথাও মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে সংবাদ পেলেই মীর কাসেম আলী ও তার সহযোগীরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে অভিযান চালাতো।
এই টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ানেও ভয়াবহতার কথা উঠে এসেছে। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়েও ডালিম হোটেলকে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বলা হয়েছে।
এখানে মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন করতো। নির্যাতনে অনেকেই মৃত্যুবরণ করতেন অথবা কাউকে মেরে ফেলার জন্য চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো।
ডালিম হোটেলের নির্যাতনের কথা ভেবে এখনো শিউরে ওঠেন নির্যাতনের শিকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তরে তাদের অনেককেই ধরে এনে ইলেকট্রিক শক, উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো, ঠোঁট থেতলে দেওয়া, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করাই ছিল বদর বাহিনীর কাজ, যেগুলোর নির্দেশদাতা ছিলেন মীর কাসেম আলী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পুরো বাড়ি ঘেরাও করে আমাদের ছয় জনের পাশাপাশি আশপাশের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাসহ আরও আটজনকে ধরে ডালিম হোটেলে নেওয়া হয়।
“দোতলার একটি কক্ষে চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে আটকে রেখে প্রতিদিনই শারীরিক নির্যাতন চালাতো।”
নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড মীর কাসেমের নির্দেশেই হতো জানিয়ে এমরান বলেন, “আমি নিজের চোখে মীর কাসেমকে দেখেছি ডালিম হোটেলে। সে নিজেই আমার নাম ঠিকানা এন্ট্রি করেছিল।’’
“তার (মীর কাসেম) নির্দেশেই চোখ বাঁধা অবস্থায় দিগম্বর করে পেটানো হত। রক্তাক্ত অবস্থায় আমাদের অন্ধকার কক্ষে ফেলে রাখা হত। দুদিন পর বাসি খাবার দেওয়া হত এবং পানি চাইলে টয়লেট থেকে বদনা করে পানি দেওয়া হত। অনেককে পানির বদলে পশ্রাব খেতে দেওয়া হয়েছে।”
বিভিন্ন কক্ষ থেকে বন্দিদের আর্ত-চিৎকারে তিনতলা ভবনের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠত উল্লেখ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “সেই সময়ের নির্যাতনের কথা ভাবলে এখনো শিউরে উঠি।’’
ওই হোটেলে মীর কাসেম আলী এলে বদর সদস্যরা ‘ডা. খান আ গ্যায়া..., কাসেম সাব আ গ্যায়া’ বলে হাঁক পাড়ত বলে জানান তিনি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতার পর তিনি অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে মুক্ত হন।
একাত্তরে নির্যাতিত হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসির উদ্দিন চৌধুরীও, আন্দরকিল্লার নজির আহমদ চৌধুরীর একটি আশ্রয়স্থল থেকে নাসির উদ্দিনকে ডালিম হোটেলে ধরে আনে বদর সদস্যরা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল এ ডালিম হোটেল। নভেম্বরের শেষ দিকে আমাকে তারা ধরে আনে। তাদের নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল পৈশাচিক। প্রতিদিনই তিনতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষ থেকে বন্দিদের আর্তনাদের শব্দ পেতাম।’
তাকেও মীর কাসেমের নির্দেশে অমানুষিক নির্যাতন করা হয় বলে জানান তিনি।
“একাত্তরে আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের প্রধান এবং অপারেশন কমান্ডার হিসেবে সকল হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের দায় তার ওপরই বর্তায়।”
ডালিম হোটেলের নির্যাতনের সময় বন্দিদের আর্তনাদের শব্দ এখনো মুক্তিযোদ্ধা নাসিরকে তাড়িয়ে বেড়ায়, নির্যাতনের কথা ভেবে এখনো শিউরে ওঠেন তিনি।
নির্যাতনের শিকার অনেকেই বলেছেন, মীর কাসেম একাত্তরে চট্টগ্রাম শহরে খোলা জিপ নিয়ে তার সহযোগীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য বের করতে অন্য টর্চার সেলগুলো থেকে তাদের ডালিম হোটেলে এনে নৃশংস অত্যাচার করা হতো।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মীর কাসেম আলীসহ বদর সদস্যরা ডালিম হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওইদিনই মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণ ডালিম হোটেল থেকে বন্দিদের উদ্ধার করেন।
ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী, তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। একাত্তরের ২৩ নভেম্বর কদমতলীর বাড়ি থেকে কারফিউ দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে।
ওই হোটেলের প্রতিটি কক্ষ থেকে আসত নির্যাতিতদের গোঙানি ও আর্তনাদের আওয়াজ। বদর সদস্যরা জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ঠোঁট থেঁতলে দিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর অন্য বন্দিদের মতো মুক্ত হন টর্চার সেল থেকে।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। এর মধ্যে দশটি ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়। আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করার পর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মীর কাসেমকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম। দেড়শ’ পৃষ্ঠার মূল আবেদন ও এক হাজার ৭৫০ পৃষ্ঠার নথিপত্রসহ করা আপিলে তিনি সাজা বাতিল করে খালাস চান।
উভয়পক্ষের শুনানি ও যুক্তিতর্কের পর মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।