একাত্তরে চট্টগ্রামের কুখ্যাত ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন ও হত্যার দায়ে আপিল বিভাগের রায়ে আল বদর নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল রয়েছে সেই জসিম উদ্দিনের এক স্বজন বলেছেন, এই রায়ে এতোদিন পর সুবিচার পেলেন তারা।
Published : 08 Mar 2016, 11:36 AM
জসিমের মামাত বোন হাসিনা খাতুন মীর কাসেমের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন।
দীর্ঘ ৪৫ বছর পর মঙ্গলবার আপিল বিভাগ মীর কাসেমের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ঘোষণার পর স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি।
হাসিনা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল থেকেই টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষায় ছিলাম। টেলিভিশন দেখেই রায় জানতে পেরেছি।
“খুব ভালো লাগছে। আমি সন্তুষ্ট। মনে হচ্ছে, এতদিন পর সুবিচার পেয়েছি। একটা কথা বলতে চাই- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যাচ্ছেন। বিচারগুলো তিনি যেন সব শেষ করে যেতে পারেন সেই দোয়াই করি।”
একাত্তরের নভেম্বর মাসে ঈদুল ফিতরের পরদিন চট্টগ্রাম নগরীর বেপারিপাড়ায় তার বাসায় এসে পোলাও খেতে চেয়েছিলেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম।
ফুফাতো ভাইয়ের আবদার মেটাতে তাকে পোলাও রান্না করে খাওয়ান তিনি। ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পরই জসিমকে ধরে নিয়ে যায় আল-বদর বাহিনী।
হাসিনা খাতুন জানান, তখন জসিমের বয়স ছিল সতের-আঠারো। সন্দ্বীপে থাকতেন তিনি, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
“তখন সন্দ্বীপে কেরোসিন সংকট হওয়ায় চট্টগ্রাম শহরে এসেছিল জসিম। ঈদের পরদিন সে আমার বাসায় আসে। পোলাও খেতে চায়। দুপুরে পোলাও-মাংস খেয়ে সে বেরিয়ে যায়।”
ওই দিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, “যাওয়ার আগে ভাই আমার সাথে অনেক গল্প করেছিল। নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ও আবদুল কাদের জিলানীর জীবনের একটি গল্পও বলেছিল।
“যাওয়ার সময় বলেছিল- দোয়া করি আপনি সারাজীবন সুখে থাকুন। সেই তার শেষ যাওয়া। এরপর বাকি জীবনটা শুধু ভাই হত্যার বিচারের অপেক্ষায় ছিলাম।”
ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনা একাদশ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়।
তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন ও হত্যায় আপিলেও চট্টগ্রামের বদর কমান্ডারের সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রাখা হয়েছে।
হাসিনা খাতুন বলেন, “ডালিম হোটেলে আটকে রেখে জসিমকে অমানুষিক নির্যাতন করা হত। একদিন নির্যাতন করার পর জসিম একটু পানি খেতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা তা দেয়নি।
“সেখানে থাকা আরেক বন্দি অ্যাডভোকেট শফিউল আলম জমিয়ে রাখা হাত ধোয়া পানি জসিমকে খেতে দেয়। নির্যাতনের পর জসিম মারা গেলে কর্ণফুলী নদীতে নিয়ে লাশ ফেলে দেওয়া হয়।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শফিউল আলমসহ অন্যরা ডালিম হোটেল থেকে মুক্তি পান জানিয়ে তিনি বলেন, “শফিউল আলমই আমাকে সেই ঘটনার কথা জানান। আমরা জসিমের লাশের কোনো হদিস পাইনি। তাকে কবরও দিতে পারিনি।”
সর্বোচ্চ আদালতে রায়ে মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল থাকায় সন্তোষ জানিয়ে দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন এই মামলার অন্যান্য সাক্ষী ও ডালিম হোটেলে নির্যাতিতরা।
সেখানে নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি খুশি অনুভব করছি। দেশ স্বাধীনের পর টর্চার সেল থেকে মুক্ত হলে বাবা-মা-ভাই বোনের মুখে যে খুশি দেখেছি আমার তেমন আনন্দ হচ্ছে।
“দেশ স্বাধীনের পর থেকেই চেয়েছিলাম মীর কাসেমের বিচার, সর্বোচ্চ সাজাই আপিলে বহাল আছে।”
মীর কাসেমের দণ্ড দ্রুত কার্যকরের পাশাপাশি সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি করেন তিনি।
ডালিম হোটেলে নির্যাতিত আরেক মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরী প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আপিলে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে জাতির প্রত্যাশা পূরণ করেছে।”
মীর কাসেমের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে মন্তব্য করে এই সাংবাদিক বলেন, “তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানকারী হিসেবে আমি এ রায়ে সন্তুষ্ট, তৃপ্ত। একজন নির্যাতনকারী, হত্যাকারী এবং এসবের মদদদাতা হিসেবে তার উপযুক্ত শাস্তিই হয়েছে।”