দুটি বাণিজ্যিক জাহাজ ও সাতটি ছোট নৌযান এখন সোমালি জলদস্যুদের জিম্মিদশায়।
Published : 15 Mar 2024, 11:33 PM
সোমালি উপকূলে গেল সাড়ে তিন মাসে ২৩টি নৌযান জলদস্যুদের কবলে পড়েছে জানিয়ে ওই এলাকায় চলাচলকারী নৌযানকে উচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স-ইইউএনএভিএফওআর।
সংস্থাটির আটলান্টা অপারেশন কার্যক্রমের তরফে বৃহস্পতিবার জলদস্যু ঝুঁকি নিয়ে এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, সম্প্রতি সোমালি উপকূলে জলদস্যুতার হুমকি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ওই উপকূল ধরে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে উচ্চ সতর্কতা বজায় রাখার অনুরোধ করা যাচ্ছে।
জলদস্যুতা প্রতিরোধ ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে লোহিত সাগর, এডেন উপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের জন্য যে ‘বিএমপিফাইভ’ জারি করা হয়েছে, জাহাজগুলোকে তা অনুসরণ করতে বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স।
পাশাপাশি সোমালি উপকূল অতিক্রমের আগে ‘বিএমপিফাইভ’ অনুসারে নিরাপত্তা ড্রিল অনুশীলন করার আহ্বান জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
বিএমপিফাইভ কী
এতে জলদস্যুতা প্রতিরোধে জাহাজে তিন ধাপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা আছে। প্রাথমিক ধাপে- জাহাজের সম্মুখভাগে সর্বোচ্চ দৃশ্যমানতা ও নজরদারি, রেজর ওয়ার (জাহাজ ঘিরে ধারালো তারের বলয়), ম্যানুভারিংয়ের ব্যবস্থা (চলাচল মহড়া) এবং ভাড়া করা নিরাপত্তা প্রহরী (পিসিএসিপি) নেওয়ার কথা বলা আছে।
দ্বিতীয় ধাপের নিরাপত্তায় জাহাজের কক্ষে শক্ত দরজার ব্যবস্থা করা, মোশন সেন্সর ও সিসিটিভি ক্যামেরা এবং নিরাপত্তা ফটক বা বিশেষ ধরনের দরজা ব্যবহারের কথা বলা আছে।
নিরাপত্তার সবশেষ ধাপে- জাহাজের অভ্যন্তরীণ দরজাগুলো মজবুত করা, সেইফ মাস্টার পয়েন্ট রাখা এবং আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা পেতে পানি স্প্রে করার ব্যবস্থা এবং ফোম ছিটানোর জন্য ফোম মনিটর রাখার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি জাহাজ দস্যুদের কবলে পড়লে এলার্ম বাজিয়ে জাহাজের সবাইকে সতর্ক করতে হবে।
এছাড়া জাহাজের ব্রিজের নিরাপত্তা জোরদার করতে ধাতব প্রটেকশন লাগানো এবং দস্যু হামলা হলে জাহাজের সব নাবিক ও ক্রুদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য সংরিক্ষত এলাকা (সিটাডেল) রাখাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা আছে বিএমপিফাইভে।
বিএমপিফাইভ অনুসারে এমভি আবদুল্লাহতে ভাড়াটে নিরাপত্তারক্ষী ছিল না। এছাড়া জাহাজে জলদস্যু ওঠার সময়ের যে ভিডিও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার হয়েছে, তাতে এমভি আবদুল্লাহতে কোনো রেজর ওয়্যারও দেখা যায়নি।
এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান জিম্মি হওয়ার দিন যে অডিও রেকর্ড পাঠিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেন, “মঙ্গলবার সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টা এবং জিএমটি (গ্রিনিচি মান সময়) সময় ৭টা ৩০ এর সময় একটা হাইস্পিড স্পিড বোট আমাদের দিকে আসতেছিল। সাথে সাথে অ্যালার্ম দিছিল। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটাডেলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ডার অফিসার ব্রিজে ছিল।
“তখন ওই জিগজ্যাগ করলাম। এসওএস (বিপদে পড়লে জীবন রক্ষায় জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকেএমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস) ট্রাই করছিলাম। বাট ইউকেএমটিও তখন ফোন রিসিভ করেনি। ওরা চলে আসল, পাইরেটসগুলা। চলে আসার পরে ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ড অফিসারকে ক্যাপচার করল।”
জিম্মিদশায় ৭টি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স এর আটলান্টা অপরাশেনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ২৪ নভেম্বর থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত ২৩টি নৌযান জলদস্যুতার শিকার হয়েছে।
এসময়ে তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালানো হয়েছে, যার মধ্যে এমভি রুয়েন ও এমভি আবদুল্লাহ এখনো জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
এসময়ে ১৮টি নৌযান ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে, যার বেশির ভাগই মাছ ধরার যান। এছাড়া আরও দুটি নৌযান হামলার শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে সাতটি নৌযান এখনো জলদস্যুদের কব্জায় আছে বলে ধারণা আটলান্টা অপারেশনের।
সাম্প্রতিক এসব ঘটনা সোমালি উপকূলে জলদস্যুতা বৃদ্ধির আভাস দিচ্ছে জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স বলছে, বর্ষা শেষে ওই অঞ্চলে জলদস্যুতা আরো বাড়তে পারে।
সংস্থাটি বলছে, তারা সোমালি উপকূলে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য জলদস্যু শিবির চিহ্নিত করেছে; যেগুলো কেপ হাপুন এবং গারাকাদ গ্রামের মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত।
আটলান্টা অপারেশনের ধারণা, জলদস্যুদের চারটি দল (পাইরেট অ্যাকশন গ্রুপ- পিএজি) জাহাজ নিয়ে সক্রিয় আছে।
জাহাজ ছিনিয়ে ব্যবহার ছিনতাইয়েই
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, জলদস্যুরা সচরাচর ছিনিয়ে নেওয়া জাহাজ দিয়ে ছিনতাইয়ের মাদার ভেসেল হিসেবে ব্যবহার করে।
মাদার শিপ হিসেবে ব্যবহার করা সেই জাহাজ নিয়েই পূর্ব সোমালি উপকূলের ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত চষে বেড়ায় জলদস্যুরা।
এরপর নিশানার জাহাজ যদি আক্রমণ ঠেকাতে না পারে তাহলে সেই জাহাজে উঠে পড়ে জলদস্যুরা। তারপর নতুন ছিনতাই করা জাহাজ নিয়ে তারা সোমালি উপকূলে চলে যায়। এবং মুক্তিপণের আলোচনা চলা পর্যন্ত সেটিকে সেখানে আটকে রাখে।
মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন নামের জাহাজটির গতিবিধি তুলে ধরে প্রতিবদেনে বলা হয়, ছিনিয়ে নেয়ার পর রুয়েন জাহাজটিকে সোমালি উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে এখন সেই জাহাজটি উপকূল থেকে দূরে সরতে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স ধারণা করছে, এমভি রুয়েন এখন জাহাজ ছিনতাইয়ের কাজে মাদার শিপ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এটি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আরো বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার আশঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি বাণিজ্যিক জাহাজে জলদস্যুতা এবং সশস্ত্র অবস্থায় জলদস্যুদের জাহাজ নিয়ে চলাচলের একাধিক ঘটনা ঘটায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অনুসরণ করে সোমালি উপকূলে জাহাজগুলোকে চলাচল করতে বলেছে আটলান্টা অপারেশন।
পাশাপাশি এমএসসিএইচওএ ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্তক সংকেত অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
আটলান্টা অপারেশন বলছে, পশ্চিম ভারত মহাসাগরে বিশেষ করে সোমালি উপকূলের ৭০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে যারা চলাচল করে, যেসব জাহাজ যেন অবশ্যই বিএমপিফাইভ এর সুপারিশ মেনে চলাচল করে।
পাশাপাশি সাগরে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা এমএসসিএইচওএ এবং ইউকেএমটিওকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। কারণ এমএসসিএইচওএ নিবন্ধিত জাহাজগুলো তাদের কাছাকাছি দূরত্বে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার বার্তা তাৎক্ষণিক পেয়ে থাকে, যা দস্যুতা ঠেকাতে সহায়ক হতে পারে।