‘স্বনির্ভর’ সিটি করপোরেশন গড়তে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে জোর। করতে চান ‘ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’।
Published : 05 Nov 2024, 09:13 PM
আদালতের রায়ে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেনও বন্দর নগরীর আগের তিন মেয়রের মত সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সিটি গভার্নমেন্ট বা নগর সরকারের দাবি জানালেন।
দু’দিন আগে শপথ নেওয়া শাহাদাত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ফিরে সন্ধ্যায় নগরীর লালদীঘির পাড়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) পাবলিক লাইব্রেরির হল রুমে এক মত বিনিময় সভায় অংশ নেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
সিসিসি’র কর্মমকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ওই মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় দেওয়া বক্তব্যে ডা. শাহাদাত বলেন, “এমন একটি সময়ে আমি দায়িত্বভার নিয়েছি, যখন দেশ একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। চট্টগ্রাম ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন একটি জায়গায় আছে যে, চট্টগ্রামকে নিয়ে চিন্তা শুধু চট্টগ্রামের একার নয়। এ চিন্তা হচ্ছে আজকে সারা বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রীয় সরকারের।
“চট্টগ্রাম বাঁচলেই, বাংলাদেশ বাঁচবে- এই স্লোগান দিয়ে আমি আমার কাজ শুরু করব। এই চট্টগ্রাম শুধু আমার একার নয়। এই চট্টগ্রাম আমাদের। আমাদের চট্টগ্রামের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা থাকতে হবে। তখনই আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলদি সিটি করতে পারব। যেটি আমার নির্বাচনি ইশতেহার ছিল।”
আর্থ-সামাজিক বাধার কারণে চট্টগ্রাম সিটি অনেক কাজ করতে পারেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রামে যেখানে তিন থেকে চার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা ছিল। আজকে সেখানে হয়ে গেছে প্রায় নয় হাজারের মত। আজকে আমি দায়িত্ব নিচ্ছি প্রায় ৪৪০ কোটি টাকা ঘাটতি নিয়ে। বোঝা নিয়ে আজকে দায়িত্বভার বুঝে নিচ্ছি।”
মেয়র বলেন, “আপনারা অত্যন্ত সততার সাথে, দুর্নীতিমুক্তভাবে, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আমার সাথে কাজ করবেন। সমস্ত চ্যালেঞ্জ আমি নিলাম। এই সিটি করপোরেশনকে একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি আপনাদের উপহার দেব। সততা থাকতে হবে, কাজের প্রতি মমত্ব বোধ থাকতে হবে, আমার দায়িত্ব আমাকে সঠিকভাবে পালন করতে হবে।”
নতুন মেয়র বলেন,সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে গত ১৫-২০ দিন ঢাকায় অবস্থানের সময় মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছেন তিনি।
“আমি একটি কথা বলেছি, এটার জন্য যে জিনিসটা খুবই দরকার, সেটা হল সিটি গভার্নমেন্ট। নগর সরকার যদি হয় সিস্টেমের মধ্য দিয়ে, তাহলে সমস্ত সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এক ছাতার নিচে সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে কাজ করবে।
“সিটি করপোরেশনের মেয়র জনপ্রতিনিধি। সেই জনপ্রতিনিধির অধীনে যদি সমস্ত সেবা প্রদানকারী সংস্থা কাজ করে, তাহলে একটি পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব। আর এটা যেহেতু একটা সিস্টেমের ব্যাপার, সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমি চেষ্টা করব সেবা প্রদানকারী যেসব সংস্থা আছে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য।”
১৯৯৪ সাল থেকে টানা তিন বার চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হওয়া প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তার মেয়াদে প্রথম সিটি গভার্নমেন্টের দাবি তুলেছিলেন।
এরপর ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মেয়াদের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে সেসময়ের মেয়র এম মনজুর আলমও একই দাবি জানান।
তার পরে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া আ জ ম নাছির উদ্দিনও ২০১৭ সালের জুনে এক অনুষ্ঠানে দুই পূর্বসূরি মহিউদ্দিন ও মনজুরের মত সিটি গভার্নমেন্টের দাবি জানিয়েছিলেন।
আর সবশেষে শাহাদাত দায়িত্ব গ্রহণের দিনই সেই দাবি সামনে আনলেন।
রাজস্ব বিভাগকে হুঁশিয়ারি
প্রত্যেকটি বিভাগের সঙ্গে আলাদাভাবে সভা করবেন জানিয়ে মেয়র শাহাদাত বলেন, “কীভাবে সিটি করপোরেশনকে সাবলম্বী করা যায়, সিটি করপোরেশন যাতে মানুষের উপকার করতে পারে, নগরবিদ ও পেশাজীবীরা আছেন… বুদ্ধিজীবীদের ইনভাইট করব।
“রাজস্ব বিভাগে হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে কী হয়, সেটা আমি জানি। আপনারা সাবধান হয়ে যান। আমার হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। যে হোল্ডিং ট্যাক্স আমরা দিয়ে আসছি, সেই হোল্ডিং ট্যাক্স যদি আমরা ঠিকমত পাই, তাহলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বেতন দেওয়ার জন্য আর কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ওটাও আমরা পাচ্ছি না বিভিন্ন কারণে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। ওটার জন্য আপিল করতে করতে এখনো ৩০-৪০ শতাংশ লোক হোল্ডিং ট্যাক্স আর দিচ্ছে না। মাঝখানে একটা গ্রুপ সেখানে গিয়ে কমিয়ে দেওয়ার কথা বলে এদিক ওদিক করে সিটি করপোরেশনকে দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যাবেন না। মনে রাখবেন, আপনারা সবাই বেতন পাচ্ছেন।”
ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেন্টার
পেশাজীবনে একজন চিকিৎসক ডা. শাহাদাত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চান পরিচ্ছন্নতা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে।
তিনি বলেন, “আমার হাতে সময় কম। মাত্র দেড় বছরের মত। যে কাজগুলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোতে হাত দেব। এখন প্রধান সমস্যা ডেঙ্গু। এমনভাবে কাজ করতে চাই, যেন কেউ ডেঙ্গুর চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। কারো যেন মৃত্যু না হয়। পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার অভিযান চলবে সবসময়।
“ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কল সেন্টার করতে চাই। সেখানে রোগীর পরিবার থেকে ফোন করা হলে আমাদের ডাক্তাররা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। প্রতি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু হেল্প ম্যানেজমেন্ট সেন্টার করার চিন্তা করছি। এখন ইমার্জেন্সি কাজ ডেঙ্গু ও পরিচ্ছন্নতা।”
তিনি বলেন, “আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই। অফিসে বেশিক্ষণ থাকব না। নিজেই বেরিয়ে যাব। পরিচ্ছন্নতা বিভাগের লোকজন আমার সাথে থাকবে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে সশরীরে পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মীদের দেখতে চাই। যদি কাউকে গিয়ে না দেখি, তাদের চাকরি নাও থাকতে পারে। আমাকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। অত্যন্ত দ্রুততার মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে প্রোগ্রাম দেব।
“মশার লার্ভিসাইড কিল করার যে স্প্রে এর কোয়ালিটি আমি টেস্ট করতে চাই। এমন কোনো স্প্রে চাই না যাতে মশা মরবে না। ওই ওষুধ আমি গ্রহণ করব না। আমি নিজেই স্পটে যাব।”
ডা. শাহাদাত বলেন, “পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় জোর দিতে চাই। সমস্ত বিন রেডি করে রাখবেন। দোকানের সামনে বসিয়ে দেব। দোকানের সামনে পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দোকান মালিকদের। বাড়ির আঙ্গিনাও বাড়ির মালিকের। নতুবা আমি ব্যবস্থা নেব। নতুবা হোল্ডিং বা ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।
“কোন ভয় ভীতি ধমক দিলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করবেন। আমি রাজনীতি করে বড় হয়েছি। প্লিজ দেশকে ভালোবাসুন। দেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে নতুন প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবেন না।”
স্বাস্থ্য-শিক্ষায় ‘সুনাম’ ফেরানো লক্ষ্য
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অতীত সুনাম ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেও কাজ করার বথা বলেন মেয়র শাহাদাত।
তিনি বলেন, “মেমন হাসপাতাল চট্টগ্রামে ১ নম্বর ছিল। ওই জায়গায় আবার দেখতে চাই। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, সেগুলোকে উন্নত করতে চাই। সিটি করপোরেশনকে একটা পরিবর্তনের জায়গায় নিয়ে আসতে চাই।
“আপনারা জানেন, এই প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের টাকা দিয়ে কেনা। আজকে সেটা বেদখল হয়ে গেছে। আমরা যারা রাজনীতি করি অনেকে বড় বড় কথা বলি। কিন্তু আমাদের ঘরে অনেক কিছু পাওয়া যায়, যখন ক্ষমতা চলে যায়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমাদের উদ্ধার করতে হবে।”
কাউন্সিলরদের শূন্যস্থানে যুবকদের সম্পৃক্ত করার ইচ্ছা
নতুন মেয়রের কাছে প্রশ্ন ছিল, কাউন্সিলরদের ছাড়া কীভাবে সিটি করপোরেশনের মত একটি জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন?
জবাবে মেয়র শাহাদাত বলেন, “আমরা একটা ক্রান্তিকাল পার করছি। সিসিসির ওয়ার্ড সচিবরা আছেন। প্রতিটি এলাকায় অনেক পেশাজীবী আছেন। কর্মঠ যুবকরা আছেন। যারা কাজ করতে চান, সবাইকে সম্পৃক্ত করে কাজ করতে চাই।
“ইতিমধ্যে বিভিন্ন সনদ দিতে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ আগামী সিটি নির্বাচন পর্যন্ত সবাই মিলে কাজ করতে হবে।”
ফুটপাত উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যে কাজটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, সে কাজ থেকে শুরু করতে চাই। এই কাজে চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি সেবা প্রদানকারীদের সমন্বিত করা। সিএমপি, হকার, সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে।”
যথারীতি প্রশ্ন ছিল নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়েও। জবাবে শাহাদাত বলেন, “জলাবদ্ধতা নিয়ে একটা মাত্র প্রকল্প চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। ১২৬০ কোটি টাকার। সরেজমিনে দেখে ঠিক করব কবে সেটা শেষ হবে৷
“বড় প্রকল্পটি সিডিএ করছে। আওয়ামী লীগের আমলে সিডিএ’র চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। তখন মেয়র কাজ পাননি। সিডিএ সেই কাজ নিয়ে আসে। প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট সিডিএ করছে। সিডিএ চেয়ারম্যান মহোদয়কে আমি ফোন করেছি। উনার সাথে সংবাদ সম্মেলন করে জানাব কাজ কতটুকু হয়েছে। কবে শেষ হবে।”
সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র শাহাদাত বলেন, “দুদকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, তাদের বিষয়ে জানতে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলদের ডাকব। কারো বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ থাকলে তাদের আইনের আওতায় আনব।”
বিএনপির নেতাকর্মীদের অফিস সময়ে নগর ভবনে এসে ‘ডিস্টার্ব’ না করার আহ্বান জানান দলটির নেতা শাহাদাত।
চট্টগ্রামের সাবেক ও বর্তমান দুই মেয়রই চান 'সিটি গভর্নমেন্ট'
চট্টগ্রামে 'সিটি গভর্নমেন্ট' চান রেজাউলও
ভোটের সাড়ে তিন বছর পর শাহাদাতকে চট্টগ্রামের মেয়র ঘোষণার রায়