“আমাদের সব রকমের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। আশা করি, বাকি সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে,” বলছেন প্রকল্প পরিচালক।
Published : 15 Oct 2023, 01:30 AM
কক্সবাজারের পথে ট্রেন চলাচলে একযুগ আগে যে প্রকল্পে হাত দিয়েছিল সরকার, সেই ‘স্বপ্নযাত্রা’ অবশেষে পূরণ হতে চলেছে। আগামী ১২ নভেম্বর সেই পথে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগে চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ।
উদ্বোধনের আগে ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পথে ট্রেনের ট্রায়াল রান হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। নভেম্বরের প্রথম দিকে হতে পারে ট্রায়াল রান। এর মধ্যেই কালুরঘাট সেতুর প্রাথমিক মেরামত কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের পথে রেল ট্র্যাক (ট্রেন চলাচলের পথ) নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হলেও নতুন নির্মিতব্য ৯টি স্টেশনের মধ্যে কয়েকটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। বাকি আছে কিছু লেভেল ক্রসিংয়ের কাজও।
স্টেশনগুলোর কাছে একাধিক লুপ লাইন প্রকল্পে থাকলেও আপাতত একটি করে লুপ লাইন প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তাই উদ্বোধনের আগে হাতে থাকা এক মাস সময়ের মধ্যে ট্রেন চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটুকুই শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করেছে রেলওয়ে।
কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়ায় ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশনের বাকি কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত এবং যাত্রীদের জন্য ওয়েটিং রুম ও এস্কেলেটরসহ আনুষাঙ্গিক কাজ শেষের পথে।
‘কু ঝিকঝিক’ শোনার অপেক্ষায় পর্যটন নগর
এই প্রকল্প শুরুর আগে পর্যটন শহর কক্সবাজারের সাথে কোনো রেল যোগাযোগই ছিল না। শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা ছিল।
পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার সদর ও রামুতে প্রথমবারের মত রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চন্দনাইশের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আগে থেকে ছিল। এরপরের অংশ এই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১২ নভেম্বর এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন। সারাদেশের মানুষের অপেক্ষার অবসান হবে।
“এই প্রথম সমুদ্র শহর কক্সবাজার রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। আমাদের সব রকমের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। আশা করি, বাকি সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে।”
সংস্কার কাজে ৩ মাসের জন্য বন্ধ হল কালুরঘাট সেতু
সাগরের গর্জন আর ট্রেনের ঝিকঝিক মিলবে যেখানে
রামু হয়ে ঘুমধুমে ট্রেনযাত্রা ঝুলে গেল
উদ্বোধনের পর বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল কবে শুরু হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এটি বহুল প্রতীক্ষিত এক রেললাইন। একদিন আগেও যদি ট্রেন চালু করা যায়, তাতে সড়কের উপর চাপ কমবে। মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারবে। এছাড়া উদ্বোধনের পর মানুষের এত আগ্রহ থাকবে ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার যাবার যে, নিয়মিত ট্রেন চালুতে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই।
“ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে কক্সবাজারের পথে ট্রেন চলাচলের প্রাথমিক প্রস্তাব করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে যে ট্রেনটি চলবে, সেটি দিনে কয়েকবার চলাচল করতে পারবে। যাত্রী চাহিদা অনুসারে শিডিউল চূড়ান্ত করা হবে।”
কালুরঘাটে অপেক্ষা
ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে যেতে হলে ট্রেনকে কর্ণফুলী নদী পেরোতে হবে প্রায় শতবর্ষী কালুরঘাট সেতুর উপর দিয়ে।
১৯৩০ সালে নির্মিত ৭০০ গজের এই সেতুর পরিবর্তে নতুন সড়ক ও রেলসেতু নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার একাংশের মানুষের যাতায়াতের প্রধান উপায় এই সেতু।
কক্সবাজারের পথে রেল যোগাযোগ শুরুর আগে সংস্কার কাজের জন্য গত ১ অগাস্ট তিন মাসের জন্য কালুরঘাট সেতুতে যান চলাচল বন্ধ করা হয়। শুরু হয় সংস্কার কাজ।
১৫ অক্টোবর কক্সবাজারের উদ্দেশে চট্টগ্রাম থেকে ট্রায়াল রান হওয়ার কথা থাকলেও কালুরঘাট সেতুতে সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় তা পেছাতে হচ্ছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কালুরঘাট সেতুতে দ্রুত গতিতে সংস্কার কাজ চলছে। আশা করি, কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল উদ্বোধনের আগে কাজ শেষ হবে।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন বলেন, “কালুরঘাট সেতুর যতটুকু সংস্কার কাজ শেষ হওয়া প্রয়োজন তা এখনও হয়নি। আমরা ভালো মানের কোচ ও ইঞ্জিন দিয়ে ট্রায়াল রান করব। সংস্কারে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ২৫ অক্টোবরের মধ্যে প্রাথমিক সংস্কার কাজ শেষ করতে পারবে বলে জানিয়েছে।
“এরপর আমরা কয়েকদিন সবকিছু দেখব। যাচাই করে তারপর ১ বা ২ নভেম্বর ট্রায়াল রান করব। এর মধ্যে রেলপথের বাকি কাজগুলোও অনেকটাই এগিয়ে যাবে।”
শুরুতে দোহাজারী-কক্সবাজার অংশে ট্রায়াল রান করার কথা থাকলেও কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম নগরী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রায়াল রানের বিষয়টিও ভাবনায় আছে বলে জানিয়েছেন সুবক্তগীন।
আরো যা যা বাকি
কক্সবাজারের পথে ট্রেন চলাচল উদ্বোধনের সময় ঠিক হলেও নয়টি নতুন স্টেশনের মধ্যে তিনটির পুরো কাজ ওই সময়ে শেষ হবে না।
প্রকল্পের প্রথম অংশে হচ্ছে পাঁচটি এবং দ্বিতীয় অংশে হচ্ছে চারটি স্টেশন ভবনের কাজ।
প্রথম অংশের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক বিমল সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দোহাজারী ও চকরিয়া স্টেশনের কাজ শেষের দিকে। এগুলো উদ্বোধনের আগেই পুরো প্রস্তুত হবে।
“আর সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও হারবাং স্টেশনের কিছু কাজ বাকি থাকবে। তবে ট্রেন চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় অংশ উদ্বোধনের আগে শেষ করব। কয়েকটি লেভেল ক্রসিং বাকি আছে। যে কয়টির কাজ উদ্বোধনের পরও বাকি থাকবে, সেখানে ২৪ ঘণ্টা লোক রাখা হবে।”
বিমল সাহা বলেন, “ট্র্যাকের পুরো কাজই শেষ। এখন চেক করছি কোনো লিকেজ আছে কি না। ট্রায়াল দিয়ে দেখছি। লুপ লাইনের কাজ চলছে। পাঁচটি স্টেশনেই একটি করে লুপ করা হবে। আর দুটি করে লুপের কাজ পরে শেষ হবে।”
প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রজেক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আহমেদ সুফি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্র্যাকের কাজ ৯৯ শতাংশ শেষ। বাকি কাজও এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে।
“আইকনিক ভবনের কাজ চলছে। উদ্বোধনের জন্য আমাদের যে অংশের কাজ শেষ করার টার্গেট দেওয়া হয়েছে তা ৮-১০ দিনের মধ্যে শেষ হবে। আমাদের ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার-এই চার স্টেশনের কাজ শেষ। স্টেশনগুলোতে একটি করে লুপ লাইনও হয়ে গেছে। বাকি দুটি করে লুপ লাইনেও ওয়েল্ডিং চলছে। কাজেই বাণিজ্যিক চলাচলের জন্য এ অংশ প্রস্তুত।”
কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনে ঢোকার মুখের লেভেল ক্রসিংটি উদ্বোধনের সময় ‘অস্থায়ী ব্যবস্থাপনায়’ চালানো হবে বলে জানান তিনি।
এই প্রকল্পে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ হলেও চট্টগ্রাম নগরী থেকে দোহাজারী পর্যন্ত প্রায় ৪৭ কিলোমিটার মিটার গেজ রেললাইন।
কক্সবাজারের পথে এই রুটে ট্রেন চালাতে চট্টগ্রাম-দোহাজারী অংশে নতুন করে পাথর বিছানোসহ সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কক্সবাজারের পথে একই গতিতে ট্রেন চালাতে হলে মিটার গেজ অংশের পরিবর্তে ডুয়েল গেজ করতে হবে। সেজন্য আরেকটি পৃথক প্রকল্প নিতে হবে।”
প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন বলেন, “শুরুতে কক্সবাজারের পথে আমরা ৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালাতে চাই। তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো। সেটার উপযোগী করতে হয়ত আরো কিছু সময় লাগবে।”
পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা দিচ্ছে এবং বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্পের জন্য দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার অংশে কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
বর্তমান সরকার ২০১০ সালে প্রকল্পটির প্রথম অনুমোদন দেয়। তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ করার কথা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে।
পরে জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এডিবিকে প্রস্তাব দেয় সরকার।
এডিবি বিশদ সমীক্ষা পরিচালনা করে ট্রান্স এশিয়ান রেল লাইনের আওতায় প্রকল্পটিতে অর্থায়নে সম্মতি দেয়। এরপর ২০১৭ সালে প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির ব্যয় ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
পরে কোভিড সময়ে কাজের অগ্রগতি প্রত্যাশিত না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ঠিক করা হয়।