গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ রোধে জাতীয় কমিটি চায় রসায়ন সমিতি

এসব বিস্ফোরণ রোধে আন্তর্জাতিক মানের অপারেটিং সিস্টেম অনুসরণসহ সমিতির পক্ষে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2023, 03:02 PM
Updated : 15 March 2023, 03:02 PM

সাম্প্রতিক কয়েকটি দুর্ঘটনায় প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে রাসায়নিক ও গ্যাস বিস্ফোরণ রোধ করতে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম অনুসরণসহ শিল্প কারখানা তদারকিতে জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি।

মঙ্গলবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক মতবিনিময় সভা থেকে এসব দাবিসহ ১৪টি সুপারিশ করা হয়।

সম্প্রতি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট ও সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রাকৃতিক গ্যাস ও রাসায়নিক ব্যবহারে এবং আবাসিক ভবন ব্যবস্থাপনায় জনসচেতনা বাড়াতে এসব সুপারিশ দেওয়া হয়েছে বলে সমিতির নেতারা জানান।

গত ৪ মার্চ সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে সাতজন সাতজন নিহত হয়। এর একদিনের মাথায় ঢাকায় মিরপুর রোডের একটি ভবনে বিস্ফোরণে তিনজন, এরও একদিন পর ঢাকার সিদ্দিক বাজারে আরেক ভয়াবহ বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু হয়।

এসব দুর্ঘটনার তদন্তে ‘অনেক কমিটি’ করায় সমন্বয়হীনতা তৈরি হয় বলেও মনে করেন সমিতির সদস্যরা।

সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি জাফর আলম বলেন, “দুর্ঘটনার পরে মনিটরিং করার চেয়ে আগে করাটা জরুরি। সঠিক তদারকির অভাবেই দুর্ঘটনা ঘটে। কারখানাগুলোতে দক্ষ জনবলের সঙ্কট আছে। ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনা সচেতনতা ও মানসম্মত ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের অভাবে ঘটেছে।

“আর সরকারি যেসব সংস্থা তদারক করবে তাদেরও জনবল বাড়ানো উচিত। তাহলে তারা যথাযথভাবে কাজ করার চেষ্টা করবে। নিমতলি বা বিএম ডিপোর ঘটনার পর আমরা দেখলাম ৭-৮টা করে তদন্ত কমিটি হয়। যা প্রমাণ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে।”

তিনি বলেন, “আমরা প্রস্তাব করছি ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি করার। যারা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনকে গাইডলাইন হিসেবে ধরে কাজ করবে। এই কমিটি ক্যাবিনেট ডিভিশনের অধীনে সরাসরি কাজ করতে পারে। তাহলে এরকম বিচ্ছিন্ন তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ না হয়ে সমন্বিতভাবে হবে।

“যখনই কোনো দুর্ঘটনা হয়, আমরা জানতে চাই দায়ী কে? একজনকে দায়ী করার জন্যই যেন তদন্ত করি। কিন্তু যদি পদ্ধতি অনুসরণ করা হত তাহলে দুর্ঘটনাই ঘটত না। পদ্ধতি চালু থাকলে জানা যেত কোথায় ঘাটতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে।”

এসব ক্ষেত্রে নির্দেশনা তৈরি করে অনুসরণ করতে হবে মন্তব্য করে জাফর আলম বলেন, “রাসায়নিক মানেই বিপজ্জনক ও বিষাক্ত তা নয়। আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় বিরাট গলদ আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে সালফিউরিক এসিডবাহী গাড়ি চলছে যাত্রীবাহী গাড়ির পাশেই। কিন্তু শনাক্তকরণ সংকেত না থাকায় আমরা কেউ জানতেও পারছি না।

“সড়কপথে এভাবে রাসায়নিক পরিবহণ অত্যন্ত ঝুঁকির। এর জন্য আন্তর্জাতিক গাইডলাইন আছে। তা অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।”

দেশে শিল্পের প্রবৃদ্ধির কারণে রাসায়নিক আমদানি আরও বাড়বে জানিয়ে জাফর আলম বলেন, “এখন পরিস্থিতি এমন যে দায়ী যেন রাসায়নিক উপকরণ। যেমন বিএম ডিপোর ঘটনার পর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেল।”

এর আগে লিখিত বক্তব্যে জাফর আলম বলেন, “ব্যবহারকারীদের ও মিল-ফ্যাক্টরি কিংবা রাসায়নিক কারখানায় সম্পৃক্ত শ্রমজীবী মানুষের দক্ষতা ও সচেতনতা থাকা অত্যাবশ্যক।

“আবদ্ধ স্থানে বিপজ্জনক দাহ্য গ্যাসের উৎস, ধরন সনাক্ত করে ঝুঁকি মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ, রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ, স্বাভাবিকভাবে পরিদর্শন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য।”

বসত বাড়িতে সেপটিক ট্যাংকের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা, তদারকি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জনগণ ও শ্রমজীবী মানুষের অজ্ঞতায় জীবনহানি ঘটে জানিয়ে তিনি বলেন, “মানুষ দিয়ে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার নিষিদ্ধ করতে হবে। একাজের আধুনিক পদ্ধতি আছে। তা অনুসরণ করলে প্রাণহানি এড়ানো যাবে।

“এসব দুর্ঘটনায় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের প্রাণসংহার হয় বেশি, তাই তা সমাজে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করে, জনমনে হতাশার সৃষ্টি করে, সরকারকে বিব্রত করে।”

সমিতি যে সুপারিশ উপস্থাপন করে তার মধ্যে আছে- বিপজ্জনক রাসায়নিক ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ হ্যান্ডলিং- এ আন্তর্জাতিক বিধি মোতাবেক স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম অনুসরণ ও প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী, রাসায়নিক পরিবহনে সরকারি বা স্থানীয় সরকারের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অবগতি থাকা, ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখা, বসত বাড়িতে গ্যাসের সংযোগস্থানে গ্যাস ডিটেক্টর সংযোগ করা, নির্দিষ্ট সময় শেষে গ্যাস সংযোগ প্রদানকারী কর্তৃক সংযোগ লাইন পরীক্ষা করে নবায়ন সনদ দেওয়া, বহুতল ভবনসমূহের জন্য ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্ল্যান প্রস্তুত করা, সরকারি ও স্থানীয় সরকার সংস্থার অধীনে এনফোর্সমেন্ট ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা, বিপজ্জনক কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবহার, বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় কেমিক্যাল সমন্বয় কমিটি গঠন এবং সকল ক্ষেত্রে অংশীজনদের প্রশিক্ষিত করা।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সালাউদ্দিন রেজাসহ রসায়ন সমিতির নেতারা মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন।