“হামলা এবং প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
Published : 13 Apr 2025, 09:29 PM
মঞ্চ ভাঙচুরের পর চট্টগ্রামের ডিসি হিলে বর্ষবরণের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা না করার ঘোষণা দিয়েছে ‘সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ’।
পরিষদের সমন্বয়কারী সুচরিত দাশ খোকন রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মঞ্চ ভাঙচুর করার পর আমরা আয়োজকরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি অনুষ্ঠান না করার।”
তিনি বলেন, “আমরা প্রোগ্রাম করব না। হামলা এবং প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্তটি আমরা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (সার্বিক) জানিয়ে দিয়েছি।”
বর্ষবরণের প্রস্তুতির মধ্যেই রোববার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে নগরীর বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন ডিসি হিলে অনুষ্ঠান মঞ্চ ভাঙচুর করে একদল লোক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ৪০ থেকে ৫০ জন যুবক এসে শেখ হাসিনা বিরোধী শ্লোগান দিয়ে বর্ষবরণ উপলক্ষে করা মঞ্চ ভাঙচুর করে চলে যায়। এসময় তারা মঞ্চ, বিভিন্ন ব্যানার, চেয়ার, টেবিল ভাঙচুর করে।
এ হামলার পর সুচরিত দাশ খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোমবার সকাল থেকেই আমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরুর কথা। সে অনুযায়ী মঞ্চ থেকে আনুষঙ্গিক সকল প্রস্তুতি আমরা সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। এর মধ্যে সন্ধ্যার কিছু আগে ৪০ থেকে ৫০ জন যুবক এসে আমাদের অনুষ্ঠান মঞ্চে হামলা করে।”
চট্টগ্রাম কোতয়ালি থানার ওসি মো. আবদুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে আমাদের ফোর্স ছিল। সন্ধ্যার দিকে কিছু দুর্বৃত্ত হামলার চেষ্টা করলেও আমরা প্রতিহত করেছি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।”
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ওসি ভাঙচুর প্রতিহত করার কথা বললেও ঘটনাস্থলের ছবিতে দেখা যায় চেয়ার ও মঞ্চের কাঠামো ভেঙে পড়ে আছে, প্যান্ডেলের কাপড় ও প্যানাফ্ল্যাক্সের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের ডিসি হিলে গত ৪৬ বছর ধরে বাংলা নববর্ষ বরণ ও বর্ষ বিদায় উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান করে আসছে।
এবার ৪৭ বারের মত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জন্য গত ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে অনুমতি চেয়ে তারা আবেদন করে।
কিন্তু আয়োজকদের সঙ্গে প্রশাসনের সভায় নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে অনুষ্ঠানের অনুমতি ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে আয়োজকরা অনুষ্ঠান করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যান।
পরে ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজক কমিটির সঙ্গে বৈঠকে ডিসি হিলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেওয়া হয়।
তবে শর্ত দেওয়া হয়, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর গানের তালিকা প্রশাসনকে আগেই দেখাতে হবে।
পহেলা বৈশাখের এ অনুষ্ঠান দেখভাল করার জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি তদারকি কমিটিও করে দেওয়া হয়।
আয়োজকরা সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করার অনুমতি চাইলেও তাদের বিকাল ৪টার মধ্যে শেষ করতে বলা হয়। পাশাপাশি ‘বিতর্ক হতে পারে’–এমন কোনো গান বা কবিতা না রাখার অনুরোধ করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এবারে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ৬০টির মত সাংস্কৃতিক সংগঠনের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল।
তবে অনুষ্ঠান না করার ঘোষণা দেওয়ার পর আয়োজকরা ডিসি হিল এলাকা ত্যাগ করেন।
এদিকে এর আগে রোববার সকালে চট্টগ্রামের ডিসি কার্যালয়ের সামনে ডিসি হিলের অনুষ্ঠানে ‘পতিত স্বৈরাচারের দোসর’ সংগঠনগুলোকে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধবন্ধন ও সমাবেশ করে ‘সম্মিলিত বাংলা নববর্ষ উদযাপন মঞ্চ‘ নামে একটি সংগঠন। তারা ডিসির কাছে একটি স্মারকলিপিও দেয়।
বিএনপির সহযোগী সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাস নেতাদের অংশগ্রহণে হওয়া মানববন্ধনের ওই কর্মসূচি থেকে ডিসি হিলের অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি সংগঠনকে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়ার তালিকাও দেওয়া হয়।
পরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বেশ কয়েকটি আবৃত্তি ও গানের দলকে বাদ দেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সকালে মানববন্ধনকারীদের অন্যতম উদ্যোক্তা জাসাস চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সদস্য সচিব মামুনুর রশিদ শিপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডিসি হিলের অনুষ্ঠানের নামে আয়োজকরা ’পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের’ পৃষ্ঠপোষকতা করছিল।
”বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে তারা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা করতে পারে, সেকারণে আমরা তাদের বাদ দেওয়ার জন্য দাবি তুলেছি।”
সমন্বয়কারী সুচরিত দাশের অভিযোগ, “জেলা প্রশাসন থেকে আমাদের ১৫-২০টি সংগঠনকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা বলেছি তাদের বাদ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমরা তাদের বলেছিলাম যেসব ব্যক্তি নিয়ে বিতর্ক আছে তাদের বিষয়ে কিছু বললে বাদ দেওয়া হবে। এছাড়া আমরা সকল সংগঠন এবং তাদের গান ও কবিতার তালিকা আমরা প্রশাসনকে দিয়েছিলাম।”
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার শাহীদ ইশরাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”সকালে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কার্যালয়ের সামনে কিছু লোক মানববন্ধন করেছিল। তাদের দাবি অনুষ্ঠানকারীদের মধ্যে বিগত সরকারের সমর্থক আছে। তাদের করতে দেওয়া যাবে না।”
সেকারণে রোববার বিকালে ১৩টি সংগঠনকে অনুষ্ঠান থেকে বাদ দিতে ডিসি হিলের বর্ষবরণের আয়োজকদের বলা হয়েছিল বলে তুলে ধরেন তিনি।
সংগঠনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, খেলাঘর আসর, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, নরেন আবৃত্তি একাডেমি, ওড়িশি ট্যাগোর অ্যান্ড ডান্স।
প্রশাসনের সব শর্ত মানার পরও তারা এ নির্দেশনা দিয়েছিল বলে দাবি করেন সুচরিত দাশ। সন্ধ্যার পর হামলার ঘটনা ঘটায় তারা সংগঠনের সবার সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে তুলে ধরেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”অনুষ্ঠানটি আমাদের জায়গায় হলেও সেটি বাতিলের এখতিয়ার নেই। তারা আমাদের জানিয়েছে প্রোগ্রাম করবে না।”
হামলার পর রাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান কোতয়ালি থানার ওসি আবদুল করিম।