“বন্দরে অনেক কাজ হচ্ছে। বন্দরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে চাই,” বলেন তিনি।
Published : 06 Feb 2025, 07:21 PM
চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক প্রচুর বিনিয়োগ আসছে তুলে ধরার পাশাপাশি নৌ পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বে টার্মিনাল নিয়ে অগাস্টের মধ্যে ‘ভালো খবর’ পাওয়ার বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, বন্দরে বিনিয়োগের হওয়ার মানে এ অঞ্চলের উন্নতি হওয়া এবং মানুষের কর্মসংস্থান হওয়া।
দেশের ভবিষ্যৎ বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক মানের বন্দরের কথা মাথায় রেখে ১০ বছর আগে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এর তিন বছর পর প্রকল্পের সমীক্ষা যাচাই হলেও মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় গত বছরের নভেম্বরে।
তবে গত বছর সরকার পতনের ধাক্কায় কাজ থমকে যায়।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বেশ কিছুকে ‘বিলাসী’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করছে।
এর মধ্যে বে-টার্মিনাল প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হলেও নৌ পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘এটি চলমান থাকবে’।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের নিলাম গোলা ও বন্দর জেটি পরিদর্শন শেষে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “বন্দরকেন্দ্রিক প্রচুর বিনিয়োগ আসছে। বিশেষ করে বে টার্মিনাল, লালদিয়া চর ও এমনকি লালদিয়ার পাশের এলাকা ঘিরে আরেকটি বিনিয়োগ নিয়েও আলাপ আলোচনা হচ্ছে।
“বে টার্মিনালের চ্যানেল তৈরি ও স্রোত প্রতিরোধ (ব্রেক ওয়াটার) তৈরিতে বিশ্বব্যাংক ৬৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। আশা করি আগামী ৩–৫ মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটা এমওইউ চুক্তি হবে। এটি হবে বাংলাদেশে অন্যতম সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ।”
এক সাংবাদিক মাতারবাড়ী বন্দর ও বে টার্মিনালসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজ থমকে আছে বলে তুলে ধরলে উপদেষ্টা বলেন, “থমকে যায়নি। কাজ চলছে। মাতারবাড়ি বন্দর জাপানিরা করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে বন্দর পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু করবে। সেখানে এখনো কয়েকটা জেটি কাজ করছে, কয়লা নামছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য।
“বে টার্মিনাল নিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে ভালো খবর শুনতে পাবেন। বিশ্বব্যাংকের সাথে আমাদের মিটিং হয়েছে। এটা ডিপিপি তৈরি হয়ে গেছে। আশা করি অগাস্টের মধ্যে সবগুলো খবর পাবেন। সেখানে একটা টার্মিনাল ডিপিওয়ার্ল্ড, একটা পিএসএ সিঙ্গাপুর এবং আরেকটা আবুধাবি পোর্ট ও চিটাগাং পোর্ট মিলে করবে। লালদিয়ায় ডেনমার্কের মায়ের্কস করবে।”
বেশি ড্রাফটের বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভেড়ানো, চলমান বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে বন্দর সম্প্রসারণের বিষয়টি মাথায় রেখে ২০১৪ সালে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় ‘বে-টার্মিনাল’ প্রকল্প করার কাজ হাতে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
২০১৭ সালে বিদেশি একটি কোম্পানি এ প্রকল্পের কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমীক্ষা করে মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। গত বছরের নভেম্বরে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ দুটি কনটেইনার টার্মিনাল, ১ হাজার ৫০০ মিটার দীর্ঘ একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনালসহ মোট তিনটি টার্মিনাল তৈরির কথা রয়েছে।
৪ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিনটি টার্মিনালের ১১টি জেটি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে ১২ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশের গভীরতা) এবং ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুটি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি হয়েছে ইতোমধ্যে।
৮৭০ একর জমিতে এ প্রকল্পের কথা চিন্তা করা হলেও এখন পর্যন্ত ৫৬৮ একর জায়গা বুঝে পেয়েছে বন্দর। চলতি বছরের মে মাসে এসব জমি বরাদ্দ হয়।
স্রোত থেকে বে টার্মিনালকে রক্ষার জন্য বাঁধ বা ‘ব্রেক ওয়াটার’ তৈরি ও খননকাজের জন্য বিশ্ব ব্যাংক জুন মাসে ৬৫ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে।
উপদেষ্টা বলেন, “বন্দরে অনেক কাজ হচ্ছে। বন্দরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে চাই। এ জন্য সব বন্দর নিয়ে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন হচ্ছে।”
তার আগে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনি শুক্রবার কক্সবাজার যাবেন, শনিবার যাবেন টেকনাফ। টেকনাফে মিয়ানমারের সঙ্গে বন্দর আছে, সে জায়গা দেখবেন।
ঘুমধুম এলাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত। ভবিষ্যতে সেখানে স্থলবন্দর করা যায় কিনা তা দেখবেন।
উপদেষ্টা বলেন, “আগামীতে মিয়ানমারে যাই থাকুক না কেন, আমাদের সঙ্গে রাখাইন স্টেটের একটা সম্পর্ক আগে ছিল এবং থাকবে। যেহেতু রোহিঙ্গারাও ওই এলাকার। কাজেই ওটাও দেখব, ভবিষ্যতের জন্য প্ল্যান করে রাখব, যদি দরকার হয় তাহলে ওখানে একটা পোর্ট করা যায়।”
টেকনাফ বন্দর আসলে স্থলবন্দর নয় তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা হয়তো নৌবন্দরে পরিণত হবে অথবা যদি আন্তর্জাতিক কোনো বিষয় থাকে, তাহলে এটা চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে হতে পারে।
চট্টগ্রামে কাস্টমসের নিলামের অগ্রগতি যথেষ্ট ভালো মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, “তারা বেশ কিছু অকশন করেছে এবং অকশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এনবিআরের চেয়ারম্যান সাহেব এসেছিলেন। বেশ কিছু আইনি পরিবর্তন আনতে হচ্ছে, যাতে বন্দরে বছরের পর বছর কনটেইনার পড়ে না থাকে।”
আইনি পরিবর্তনগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা হয়ে গেলে দেখা যাবে ১০-১৫ বছর ধরে এখানে আর কিছু পড়ে থাকবে না, দ্রুত নিলাম হবে। আইনি জটিলতার কারণে কাস্টমস নিলাম করতে পারছে না বলে উপদেষ্টা মন্তব্য করেন।
সাখাওয়াত বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরকে ক্লিয়ার রাখতে হবে। আপনারা জানেন, বন্দরের কার্যকারিতা বিগত ছয় মাসে অনেক বেড়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে। আমাদের জায়গা দরকার। নিলাম হয়ে গেলে আমাদের কিছু জায়গা হবে। সার্ভিস কনটেইনার কী রকম করে পড়ে আছে আপনারা দেখেছেন। বিকল্প কী হবে দেখা হচ্ছে।
“মোংলা বন্দরকেও আমরা উন্নত বন্দর করতে চাই। সেই প্রকল্প পাস হয়েছে। সেই প্রকল্পে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।”
বন্দরটিকে আন্তর্জাতিক বন্দরব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের নিলাম শেড ও কার শেড পরিদর্শনে যাওয়ার সময় নৌ পরিবহন উপদেষ্টাকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ করেন বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতারা। এসময় বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন তারা।
উপদেষ্টা গাড়ি থেকে নেমে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি শ্রমিকদের বলেন, দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
পরে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অনেক কথা আছে। আমি শুনেছি। বলেছি, শুধুমাত্র তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য চট্টগ্রাম আসব। একটিই কথা বলেছি যে, দেশের ক্ষতি হোক এমন কিছু আমরা করব না।”
পরিদর্শনের সময় উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান ও বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।