‘‘চারজনের মৃত্যুর পর জাহাজ দুটি পরিত্যক্ত হচ্ছে। একপ্রকার মানুষের জীবনের বিনিময়ে জাহাজ দুটি ফেইজ আউট করা হচ্ছে। এটি খুবই দু:খজনক,” বলেন এক ক্যাপ্টেন।
Published : 06 Oct 2024, 01:25 AM
রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে ১৯৮৭ সালে যুক্ত হয় ডেনমার্ক থেকে আনা দুটি তেলবাহী জাহাজ ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’।
মূলত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আমদানি করা তেল গভীর সমুদ্র থেকে খালাস করে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে আনার কাজ করত ট্যাংকার দুটি।
সাধারণত একটি অয়েল ট্যাংকার ২৫ বছর পর্যন্ত ‘লাইফটাইম’ থাকলেও জাহাজ দুটি রাষ্ট্রীয় ‘প্রয়োজনে’ ৩৭ বছর ধরে অপারেশনাল কার্যক্রমে ছিল। এক বছর আগে জাহাজ দুটি স্ক্র্যাপ হিসেবে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে তা থেকে সরে এসে পুনরায় জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করে বিএসসি।
পুরানো হওয়ায় উচ্চ মূল্যে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সচল রাখার চেষ্টার মধ্যে পাঁচ দিনের ব্যবধানে ট্যাংকার দুটিতে বিস্ফোরণের পর আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। পৃথক ঘটনায় জাহাজ দুটির মোট চারজন নাবিক প্রাণ হারান।
ট্যাংকার দুটি অনেক বেশি পুরনো হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় দেশের সমুদ্রসীমার বাইরে যাবার পর্যায়েও ছিল না। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে অপরিশোধিত তেল খালাসের (লাইটার) কাজ করে আসছিল।
ঝুঁকি নিয়ে চলাচলের মধ্যে আগুন লেগে চারজন নিহত হবার পর অবশেষে বিএসসি তাদের জাহাজ দুটি সমুদ্র পরিবহন থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেছেন, বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি আর সমুদ্রে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে না। তাদের পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গার ইয়ার্ডে ভেঙে ফেলা হবে।
বিএসসি বলছে, জাহাজ দুটি প্রত্যাহারের পর বড় জাহাজ থেকে তেল খালাসের জন্য ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজ ভাড়া করা হচ্ছে।
এমডি বলেন, ওই জাহাজ এলে বিপিসির আমদানি করা জ্বালানি তেল ইস্টার্ন রিফাইনারি সংলগ্ন বন্দরের ডলফিন জেটি পর্যন্ত লাইটারিংয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে বন্দরের ডলফিন জেটিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ক্রুড অয়েল খালাসের সময় বাংলার জ্যোতির সামনের অংশে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় জাহাজটিতে ১১ হাজার ৭০০ টন ক্রুড অয়েল ছিল। আগুনের ঘটনায় একজন ক্যাডেটসহ তিনজন নিহত হন।
সেসময় বিএসসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল স্পার্ক বা জমে থাকা গ্যাস থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ৩৭ বছরের পুরনো জাহাজ নিয়ে সমালোচনার মুখে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল মালেক বলেছিলেন, বাংলার জ্যোতি নিয়মিতভাবে সংস্কার এবং মেইনটেনেন্স করা হয়ে থাকে। এ নিয়ে কোনো ত্রুটি ছিল না।
এই ঘটনার পাঁচদিন পর শুক্রবার মধ্যরাতে বহির্নোঙ্গরে অপর একটি মাদার ভ্যাসেল থেকে ক্রুড অয়েল লাইটার করে নিয়ে আসার সময় চার্লি অ্যাংকরেজে বাংলার সৌরভে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
জাহাজ থেকে নামার সময় পানিতে পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন ক্রু মারা যান। জাহাজটিতেও ১১ হাজার ৫৫ টন ক্রুড অয়েল ছিল।
এ ঘটনায় বিএসসি‘র এমডি জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে ‘নাশকতা’ আছে কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি এই জাহাজেও সর্বোচ্চ সতর্কতা ও মেইনটেনেন্স করা হত বলে দাবি করেন।
এই দুই ঘটনার পর তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বাংলার জ্যোতি ও ‘বাংলার সৌরভকে ফেইজ আউট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অর্থাৎ জাহাজ দুটিকে বিএসসির বহর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এটি আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও এখনও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়নি।
”এর আগেও একবার জাহাজ দুটিকে স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ক্রুড অয়েল লাইটার করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল।”
বিএসসির আরেক এক কর্মকর্তা বলেন, লাইফটাইম অতিক্রম করার পরও অপারেশনাল কার্যক্রমে থাকায় জাহাজ দুটি মেরামত কাজে অনেক বেশি অর্থ খরচ হত। ঝুঁকি নিয়েই এতদিন তারা সার্ভিস দিচ্ছিল। বহর থেকে অব্যাহতির পর জাহাজ দুটি স্ক্র্যাপ করা হবে।
এ দুটিসহ বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা ছিল সাতটি। এ দুটি বাদ পড়ার পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন জাহাজ থাকছে পাঁচটি। এগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমুদ্রপথে পণ্য পরবিহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
দীর্ঘসময় ধরে জাহাজ পরিচালনার সাথে অভিজ্ঞ মেরিনার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি খুবই পুরনো দুটি জাহাজ। প্রপার মেনটেইনেন্স হয়নি। এ ধরনের জাহাজ সমুদ্রযাত্রার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘসময় ধরে তারা দেশের সমুদ্র সীমার বাইরে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না।
এ ধরনের জাহাজে ক্রুদের ঝুঁকিতে কাজ করতে হয় দাবি করে তিনি বলেন, আর্ন্তজাতিক মান অনুযায়ী সাধারণত অয়েল ট্যাংকারে লাইফটাইম ২৫ বছর পর্যন্ত। এরপরে জাহাজগুলো অতিরিক্ত রক্ষাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশি পড়ে।
‘‘দুটি পৃথক ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর পর জাহাজ দুটি পরিত্যক্ত হচ্ছে। একপ্রকার মানুষের জীবনের বিনিময়ে জাহাজ দুটি ফেইজ আউট করা হচ্ছে। এটি খুবই দু:খজনক।’’
ডেনমার্কের শিপইয়ার্ডে তৈরির পর ১৪ হাজার ৫৪১ টন ধারণ ক্ষমতার বাংলার জ্যোতি বিএসসির বহরে যুক্ত করা হয় ১৯৮৭ সালের মে মাসে। একই ধারণক্ষমতার বাংলার সৌরভ বহরে যুক্ত হয় একই বছরের জুন মাসে।
বিএসসির এমডি মাহমুদুল বলেন, বাংলার জ্যোতি দুর্ঘটনার পর জাহাজে থাকা ১১ হাজার টন ক্রুড অয়েল খালাস করা হয়েছে। এটি বর্তমানে কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডের কাছে আছে। শুক্রবার মধ্যরাতে আগুন লাগা বাংলার সৌরভ এখনো বর্হিনোঙ্গরের চার্লি অ্যাংকরেজে রয়েছে।
সেখানে থাকা ক্রুড অয়েল এখনো ‘ভালো’ আছে দাবি করে তিনি বলেন, জাহাজটি পরিদর্শনের পর পরিস্থিতি বুঝে তেল খালাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বাংলার জ্যোতিতে আগুন লাগার পর বিপিসি ও বিএসসির পক্ষ থেকে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ হাসনাতকে প্রধান করে করা কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনে জাহাজের সামনের অংশের রশি, নোঙ্গর ও স্পেয়ার পার্টস রাখার স্থান থেকে বিস্ফোরণের ফলে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই স্থানে বিপুল পরিমাণ গ্যাস জমে তীব্র বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে কমিটি মনে করছে। বিস্ফোরণে জাহাজটির সম্মুখভাগ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলার জ্যোতি ৩৭ বছরের পুরনো জাহাজ হওয়ায় এটিকে কার্যকরভাবে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যাবে কি না অথবা এর সম্ভাব্য বিকল্প কি হতে পারে তা নিয়ে বিএসসি’র মতামত নেওয়ার সুপারিশও করে কমিটি।
কমিটির প্রধান শরীফ হাসনাত বলেন, গ্যাস জমে ইলেকট্রিক স্পার্কের কারণে বিস্ফোরণ ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। তিনি এজন্য বিকল্প হিসেবে তেল খালাসের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (ডাবল পাইপ লাইন) অচিরেই চালুর সুপারিশ করেন।
শুক্রবার মধ্যরাতে বাংলার সৌরভে বিস্ফোরণের পর শনিবার বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল মালেক সংবাদ সম্মেলন করেন।
এতে তিনি জাহাজের সামনের অংশে চারটি পয়েন্টে আগুন লাগাকে নাশকতা বলে সন্দেহ করেন।
তিনি বলেন, মধ্যরাতে ওই জাহাজে কোন অপারেশনাল কার্যক্রম ছিল না। সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সেটিতে চার জায়গায় আগুন লেগেছে।
”জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা ইস্যুতে এটি নাশকতা কি না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।”
বিএসসি গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে বলে মনে করেন তিনি।
'বাংলার জ্যোতির' পর এবার অয়েল ট্যাংকার 'বাংলার সৌরভে' আগুন
চট্টগ্রাম বন্দরে অয়েল ট্যাংকারে আগুন
বাংলার সৌরভের আগুনে 'নাশকতা' দেখছেন বিএসসির এমডি